ঈগল থেকে শিক্ষা

ঈগল


বিধাতা পৃথিবীকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে প্রকৃতি থেকে মানুষ শেখার জন্য অসংখ্য উৎস খুঁজে পায়। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ দাবিদার হলেও পশু-পাখিদের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। নেতৃত্ব থেকে শুরু করে পারিবারিক বন্ধন অনেক কিছুই আমরা তাদের দৈনিক কার্যক্রম দেখে শিখতে পারি। ঈগলকে আমরা চিনি শক্তিধর, দক্ষ একটি শিকারি পাখি হিসেবে। তবে পাখির রাজা ঈগল নিজ জীবনে মেনে চলে সাতটি মূলনীতি, যা মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়। ঈগল অনেক উঁচুতে ওড়ে এবং কখনোই চড়ুই কিংবা অন্য ছোট পাখিদের সঙ্গে মেশে না, ওড়েও না। কাক-চড়ুই যেহেতু ঈগলের সমান উঁচুতে উড়তে পারে না, তাই ঈগল তাদের সঙ্গে দল বাঁধে না। এ জন্যই ঈগল একা ওড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারও সঙ্গে দল বেঁধে নয়।

মানুষ হিসেবে আমাদের জীবন চলার পথে এমন মানুষগুলোর সঙ্গেই চলতে মিশতে হবে, যারা সমান স্বপ্ন দেখে। যাদের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি মেলে, যাদের সঙ্গে থাকলে ব্যক্তিগত উন্নয়ন সম্ভব হবে। বন্ধুত্ব করতে হবে সম-মানসিকতার মানুষের সঙ্গে এবং এড়িয়ে চলতে হবে এই কাক ও চড়ুইদের, যাদের সঙ্গে জীবনের লক্ষ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ঈগলের রয়েছে তীক্ষ দৃষ্টিশক্তি, যার মাধ্যমে সে আকাশে থাকা অবস্থাতেই পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত একেবারে স্পষ্ট দেখতে পায়। ঈগল যখন তার শিকার খোঁজে, সে তার সব ফোকাস তার উপর নিয়ে ঝাপটে পড়ে। যত বাধাই আসুক না কেন, সেটিকে না পাওয়া পর্যন্ত ঈগল কোনোক্রমেই তার চোখ সরায় না।

ঈগল যেমন খুব স্পষ্টভাবে সবই দেখতে পায়, কিন্তু ফোকাস করে শুধু একটি প্রাণীর ওপর, তেমনভাবে আমাদেরও ফোকাস রাখতে হবে যেকোনো একটি কাজের ওপর। নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সেই একটি লক্ষ্যের পেছনেই ছোটতে হবে। যত বিপত্তিই আসুক না কেন, ফোকাস রাখতে হবে সেটির উপর।পাখির রাজা ঈগল সর্বদা জীবন্ত প্রাণীকে খাবার হিসেবে খেয়ে থাকে। কখনোই কোনো মৃত জিনিস ভক্ষণ করে না। রোজ রোজ নতুন শক্তির চাহিদায় ঈগল পাখি কখনোই মৃত কিছু খায় না বরং জীবন্ত ও নতুন শিকারের পেছনে ছোটে। ঠিক একইভাবে গতিশীল পৃথিবীতে নিজেকে এগিয়ে রাখার লক্ষ্যে নিজেকে সর্বদা নতুন সব তথ্য দিয়ে আপডেটেড রাখতে হবে। প্রতি সেকেন্ডেই বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। তাই সার্বক্ষণিক আমাদের জানতে হবে সর্বশেষ তথ্য ও খবর। জীবনের লক্ষ্য আরও স্পষ্ট করার জন্য এসব নতুন তথ্য নতুন শক্তির জোগান দেয়। তা ছাড়া আশপাশের কিছু মানুষ মৃত ও পচা মাংসের মতোই। তারা সর্বদা এমন সব কথাই বলে, যা আমাদের নিরুৎসাহিত করে। তবে এখানেই শিক্ষা নিয়ে হাজির হয় ঈগল পাখি। সে যেমন চড়ুই-কবুতরের মতো পাখিদের জন্য নিরুৎসাহিত না হয়ে আরও উঁচুতে উড্ডয়ন করে, আমাদেরও কোনো কিছুতে কান না দিয়ে ঈগলের মতোই এগিয়ে যেতে হবে নিজের স্বপ্ন ছুঁতে। ঝড় এলে পাখিরা যখন পাতা ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, ঈগল তখন ঝড়ের বিরুদ্ধে তার ডানা ঝাপটে যায় এবং ঝড়ের বেগকেই কাজে লাগিয়ে মেঘকে ভেদ করে উপরে উঠে যায়। এমনকি একবার বাতাসের বেগ পেয়ে গেলেই ঈগল তার ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে দেয় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উপরে যেতে থাকে। ঝড়কে যেন সে খুব ভালোবাসে। চ্যালেঞ্জকে চ্যালেঞ্জ নয়, সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। অন্য সব পাখি যখন আশ্রয়ের জন্য জায়গা খোঁজে, ঈগল তখন ঝড়ের মাঝেও উড্ডয়নে মগ্ন থাকে। ঝড়ের বেগকে কাজে লাগিয়েই ঈগল টিকে থাকে বৈরী আবহাওয়ায়। তাই সাফল্য পিপাসু একজন স্বপ্নবাজকেও প্রতিটি চ্যালেঞ্জ সাদরে গ্রহণ করতে হবে। একমাত্র প্রতিকূল পরিস্থিতিই পারে নতুন কিছু শেখাতে, সমস্যা সমাধানের দারুণ দক্ষতাটি বাড়াতে। অতএব, চ্যালেঞ্জ এলে এড়িয়ে না গিয়ে তার মুখোমুখি হতে হবে, দৃপ্ত হাতে লড়তে হবে। বাধা নয়, শক্তিতে পরিণত করতে হবে, ঠিক যেভাবে ঈগল করে।

একটা মেয়ে ঈগল ও ছেলে ঈগল যদি বন্ধু হতে চায়, মেয়ে ঈগলটি প্রথমেই ছেলে ঈগলটির কমিটমেন্টের পরীক্ষা নিয়ে নেয়। প্রথম সাক্ষাতে মেয়ে ঈগলটি মাটিতে নেমে এসে গাছের একটি ডাল তুলে নেয়। তার পিছু পিছু ছেলে ঈগলটিও উড়ে যায়। মেয়ে ঈগলটি সেই ডাল নিয়ে উপরের দিকে উড়ে যায় এবং একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় যাওয়ার পর গাছের সেই ডালটি নিচে ফেলে দেয়। তার পিছু নেওয়া সেই ছেলে ঈগলটি তা দেখে ডালটি ধরার জন্য দ্রুত নিচের দিকে যায়। ডালটি সে মেয়ে ঈগলের কাছে ফিরিয়ে আনে। এই কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি কয়েক ঘণ্টা ধরে হতেই থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মেয়ে ঈগল আশ্বস্ত হয় যে, ছেলে ঈগলটি এই ডাল ফিরিয়ে আনার কাজটি আত্মস্থ করতে পেরেছে। এটা তার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পরিচয় তুলে ধরে। একমাত্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পরিচয় দিতে পারলেই পরে তারা দুজন বন্ধু হতে পারে। এখান থেকে প্রাপ্য শিক্ষা এটাই, ব্যক্তিগত জীবনেই হোক আর পেশাগত জীবনেই হোক, কারও সঙ্গে কোনো চুক্তিতে বা সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগে তার বিষয়ে যাচাই করে নিতে হবে। ঈগল আমাদের এই শিক্ষাটা কত সুন্দর করেই না দিয়েছে। ডিম পাড়ার সময় এলে বাবা-ঈগল ও মা-ঈগল এমন একটি জায়গা বেছে নেয়, যেখানে কোনো শিকারির হামলা করার সুযোগ থাকে না। বাসা তৈরির সময় ছেলে ঈগল বাসা নির্মাণের জন্য প্রথমে কিছু কাঁটা বিছায়, তার ওপর গাছের ছোট ছোট ডালা, তার ওপর আবার কিছু কাঁটা দিয়ে একদম শেষে কিছু নরম ঘাস বিছিয়ে দেয়। ছোট্ট আবাসটির নিরাপত্তার জন্য বাইরের দিকে তারা কাঁটা ও শক্ত ডালা বিছিয়ে রাখে। বাচ্চা ঈগলগুলোর যখন উড়তে শেখার সময় হয়, মা-ঈগল তাদেরকে বাইরে ছুড়ে দেয় কিন্তু পড়ে যাওয়ার ভয়ে ছানাগুলো ফিরে আসে। মা-ঈগল এবার সব নরম ঘাস সরিয়ে ফেলে পুনরায় তাদের বাইরে ছুড়ে দেয়। আর তাই ছানাগুলো যখন ফিরে আসে, কাঁটার সঙ্গে আঘাত পেয়ে তারা নিজেই বাইরে ঝাঁপ দেয় এই ভেবে যে, এত প্রিয় মা-বাবা কেন এমন করছে? এবার বাবা-ঈগল নিয়োজিত হয় তাদের উদ্ধার কাজে। নিচে পড়ে যাওয়ার আগেই সে তার পিঠে করে ছানাগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যত দিন পর্যন্ত ছানাগুলো তাদের ডানা ঝাঁপটানো না শুরু করে, এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।

ঈগল থেকে আমরা জীবনের অনেক গুলো শিক্ষা পাই। একা চলার ক্ষমতা রাখতে হবে। ঈগল অন্য পাখিদের মতো দল বেঁধে ওড়ে না। তারা একা বা নিজের প্রজাতির সঙ্গেই আকাশের উচ্চতায় ওড়ে, যেখানে অন্য পাখিরা পৌঁছাতে পারে না। অর্থাৎ নিজের লক্ষ্যকে উঁচু রাখো এবং সেখানে পৌঁছানোর জন্য দল ছেড়ে একা চলতে শেখো অথবা একমাত্র তাদেরই সঙ্গে নাও, যারা তোমার মতো দৃষ্টিভঙ্গি রাখে এবং যাদের লক্ষ্য একই। লক্ষ্য স্থির রাখো। ঈগল পাখি অনেক উচ্চতায় উড়লেও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকে। ঈগল কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব থেকেও নিজের শিকারের প্রতি ধৈর্যের সঙ্গে তীক্ষ নজর রাখে এবং সঠিক সময়ে নিজের শিকারের ওপর আক্রমণ করে তা অর্জন করে। অর্থাৎ এর থেকে আমরা এটাই শিখতে পারি, ধৈর্যের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের পরে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করো এবং তার ওপর অবিচল থাকো। ততক্ষণ হাল ছেড়ো না, যতক্ষণ না তুমি সেটাকে অর্জন করছ। বিপদের সম্মুখীন হতে শেখো। অন্য পাখিদের বিপরীত ঈগল ঝড় দেখে ভয় পায় না। তারা ঝড়ের সময় অন্য পাখিদের মতো আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় না। ঈগল ঝড় পছন্দ করে, কারণ ঝড়ের তীব্রতাকে কাজে লাগিয়ে তারা ঝড়ের ওপরে উড়তে পারে এবং তাদের ডানাকে আরাম দিতে পারে। এর ফলে ঈগল আরও শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ যেকোনো বিপদ দেখে পালিয়ে না গিয়ে আমাদের উচিত তার সম্মুখীন হওয়া এবং লড়াই করা। প্রতিটি বিপদ আমাদের কোনো না কোনো শিক্ষা দিয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের আরও শক্তিশালী করে তোলে।

Admin

Amir hossain is a social article writer. he likes to share knowledge and Interested research content of biodiversity, climate, travel, photography

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form