একদিন সকালে সেই বটগাছের নিচে চটের বস্তা পোশাক পরিহিত এক দরবেশ বসে আছেন। তিনি সর্বদা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে মগ্ন থাকেন। কখনও কিঞ্চিত চোখ মেলে, রহস্য প্রাপ্তির মত স্মিত হেঁসে পুনরায় ধ্যানে চলে যায়। মুসলিম স্টাইলে মুখ ভরা লম্বা দাঁড়ি, হিন্দু স্টাইলে ঝুটা বাঁধা চুল, মজবুত শারীরিক গঠনের অধিকারী। হিন্দু রমণীরা ‘ভোগ’ দিতে এসে ধ্যানমগ্ন দরবেশকে আবিষ্কার করেন। তাঁরা পূজা না দিয়ে, আনিত সমূদয় ফল-মূল, দরবেশের পদতলে উপহার হিসেবে রেখে দেন। চারিদিক থেকে বিলের কামলারা দুপুরের খাদ্য খাওয়ার জন্য বটের নীচে আসে। তারাও ধ্যানমগ্ন দরবেশকে তাদের আনিত খাদ্য উপহার দেয়। কামলারা বলতে থাকে- পবিত্র দরবেশের জন্য এক বেলা খানা যদি উৎসর্গই করতে না পারি, তাহলে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে কি লাভ?
এদিকে পথিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে, খাদ্য-দ্রব্যের মন মাতানো গন্ধে মাছির পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ে। লোভী মাছি খানায় বসে, দরবেশের গায়েও বসে। খালি গায়ের দরবেশ এতে অস্বস্থি বোধ করে। ভক্তিতে আসক্ত এক পথিক, দরবেশের গায়ে যাতে মাছি বসতে না পারে সেজন্য নিজের গামছা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। অন্যান্য দরবেশ ভক্তরা, যার মত করে দরবেশের উপকারার্থে নানাবিধ কাজে স্বেচ্ছাশ্রমে লেগে যায়, যাতে করে দরবেশের ধ্যানমগ্নে কোন অসুবিধা না হয়। কানে কানে বহু গ্রামে পৌঁছে, কয়েকদিনের মধ্যেই একটি ঐতিহাসিক তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে দরবেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। মানুষের মুখে মুখে দু-একদিনের মধ্যে দরবেশ সম্পর্কে খোলা-মেলা ধারনা পাওয়া গেল। তিনি সংসার বিরাগী মানুষ, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি তাঁকে রূহানী জগতে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! কারো সাথে কথা বলেন না, ছালা বস্তার পোশাক পড়তে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কারো বাড়ীতে মেহমান হতে রাজি নন, কারো দেওয়া খানা সরাসরি গ্রহণ করেন না, নিজের ইচ্ছে মত সামান্য ফল-মূল খেয়ে জীবন ধারণ করেন। এ অঞ্চলের বিভিন্ন বালা-মুসিবত দূর করতে তিনি এখানে এসেছেন। তাই অনর্থক কেউ যেন বিরক্ত না করে, নতুবা তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন।
দিনে দিনে মানুষ বাড়ে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ হরেক রকমের অভিযোগ নিয়ে দরবেশের কাছে ভিড় বাড়াতে থাকে। দরবেশ মাঝে মধ্যে একবার চোখ মেলে, উপস্থিত সবার জন্য শূন্যের মধ্যে দোয়া ছুঁড়ে দেন। বিশৃঙ্ক্ষলার মাঝেও ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মানুষ আসতে থাকে। মানুষ দরবেশের সান্নিধ্য ছাড়তে চায় না, ফলে জটলা এবং ভিড় আরো বাড়ে। উপহার হিসেবে আনিত খাদ্যের উপর দরবেশের একবার নজর পড়ল তো কথাই নেই। এক মুহূর্তে সে উপহারের প্রতি ভক্তরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। বরকতের আশায় এলাকার স্বচ্ছল-সুঠাম দেহের অধিকারীরাও সে খাদ্য কাড়াকাড়িতে অংশ গ্রহণ করে।
হঠাৎ এক কান্ড ঘটে গেল। কে বা কাহারা রাতের আঁধারে সেখানে একটি মরা গরু ফেলে যায়। সবার মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করতে লাগল। কাল থেকে গরু পচা দুগর্ন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাবে। তখন মানুষ দাঁড়াবে কিভাবে? অনেকেই বলাবলি করছিল, মরা গরুর মালিকের কাছে কি ইহকাল-পরকালের ভয় নেই? দরবেশের বদ দোয়ার কথা কি একবারও চিন্তা করেনি? সে কি একবারও ভাবেনি যে, বাবার বদদোয়ার ফলে তার গোয়ালের বাকি গরুও মরে যেতে পারে। এ ঘটনায় দরবেশ বাবাকেও কিছুটা চিন্তিত মনে হল। ভক্তরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তদন্ত করে দেখবেন এটা কার গরু? এটার পচা-গলা দুর্গন্ধ বের হলে দরবেশ বাবার হবেটা কি? তিনি কিভাবে এখানে ধ্যান করবেন? এই জায়গায় কিভাবে শত শত মানুষ অপেক্ষা করবেন? পরদিন সকালের একমুখী বাতাস বইতে শুরু করে, সেখানে অবস্থান করাটা প্রায় দায় হয়ে পড়ল। পচা দুর্গন্ধে দরবেশ বাবার চেহারায় বিদঘুটে ভাব দেখা দিলো। তাঁর নূরানি চেহারায় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানির ভাব পরিলক্ষিত হলো।
পরদিন থেকে দরবেশ বাবার আর হদিস পাওয়া গেলনা, কিছু মানুষ হন্য হয়ে সর্বত্র খুঁজেছে তাকে। কাছে পেলে প্রয়োজনে মাফ চেয়ে, হাতে-পায়ে ধরে হলেও আবার এলাকায় নিয়ে আসবে। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। সপ্তাহ খানেক পর একদিন পুলিশ এসে হাজির। পুলিশ দরবেশের খবর জানতে চায়। দরবেশ কে না পেয়ে, পুলিশি আলামতের আশায় ভক্তদের কয়েকজনের বাড়ীতে তল্লাশি চালায়। নতুন করে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে, সবাই বলাবলি করছিল, এটা দরবেশের বদদোয়ার ফল। পুলিশের তথ্য থেকে জানা যায় সম্মানীত দরবেশ চট্টগ্রাম থেকে পলাতক হয়ে ফেরারী দিন পার করছেন। সে একটি খুনের আসামী। পুলিশ দরবেশের পিছনে লেগেই ছিল কিন্তু এখানো পৌছতে যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছিল ফলে দরবেশ কে পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি। এ সমস্ত কথাকে দরবেশ অনুসারীরা পাত্তাই দিলনা, তারা বলল এটা এক প্রকার বিদ্বেষ, পুলিশ মিথ্যা বলছে। দরবেশ উকিলপুরে এলেন, অবস্থান করলেন, থাকলেন একটি কথাও কখনও কারো সাথে বলেননি; সর্বদা বোবার মত ধ্যান করলেন! ধর্মপ্রাণ মানুষ ইজ্জত দিয়ে তাকে ভাল-বাসলেন, বলাবলি করলেন, এ ধরনের নীরব মানুষের শত্রু হয় কিভাবে? এলাকাতে এখনও তাঁর যথেষ্ট সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তাঁর কোন শত্রু হয়নি, কেননা ‘বোবার কখনও শত্রু হয়না’।
Tags
গল্প