সংসার সুখের হয় পুরুষের রোজগারে

সংসার সুখের হয় পুরুষের রোজগারে

ডিম আগে না মুরগি আগে? এই ধাঁধাটির মতো নারী নাকি নর বড়, এই ধাঁধাটিও অমীমাংসিত। ইসলাম ধর্মের মতে নর-নারী দুজনেই একই সময়ে একই সঙ্গে এই পৃথিবীতে এসেছে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, আমাদের জন্ম বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ্যমে।আমাদের পূর্বপুরুষ বানর প্রজাতি থেকে রূপান্তরিত হয়েই আজ মানুষের পর্যায়ে এসেছি। আমাদের মানবগোষ্ঠীর তর্কের বিষয়বস্তু হলো শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। কে সেরা, নর নাকি নারী, কে কার বশ্যতা স্বীকার করে চলবে, তাই একদা শারীরিক শক্তিতে বলবান পুরুষ আজীবনের জন্যই নারীর প্রভুতে পরিণত হলো। সেই পশু শিকারের যুগ থেকেই এই ধারণাটি বলবান পুরুষ তার মাথায় ধারণ করে আসছে। যেহেতু পশু শিকারে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হতো বেশি, তাই পুরুষ যখন শিকারে বের হতো, তখন নারী ঘরে অবস্থান করে সন্তান জন্ম দেওয়া, সন্তান প্রতিপালন, খাবার প্রস্তুত করার কাজগুলো করত। কর্মক্লান্ত পুরুষ শিকার করা পশু নিয়ে ঘরে ফিরত। একদিকে সংসারের পোষ্যদের খাবার প্রাপ্তির আনন্দে অন্য দিকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পুরুষের প্রতি মমতায় নারী কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পুরুষটির সেবা করত। এভাবেই ধীরে ধীরে নারী চিরকালের জন্য পুরুষের সেবাদাসীতে পরিণত হলো।

যতই আমরা জেনে থাকি, সংসার সুখী হয় রমনীর গুনে, কথাটি কিছুটা সত্যি হলেও পুরোটা কিন্তু সত্যি নয় সংসারের সুখ আসে মোটা ইনকামে।

ধীরে ধীরে যুগ পরিবর্তন হলো। কিন্তু আমাদের মাথায় গেঁথে যাওয়া সেই নিয়ম আর অনুশাসন পরিবর্তন হল না। এখন পুরুষের শারীরিক শক্তি আর তেমন মুখ্য নয়। এই যুগে যোগ্যতা যাচাই করা হয় মেধার শক্তি দিয়ে। মেধা খাঁটিয়েই আজকের মানুষ একের পর এক অসম্ভবকে সম্ভব করছে, একের পর এক রহস্য ভেদ করছে। মানুষ চাঁদসহ নানা গ্রহ-নক্ষত্রের রহস্য জানতে পারছে। সাগরের তল, পাহাড়ের চূড়া এবং আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে তাদের লক্ষ্যে। এসবের কোনো কিছুতেই শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়নি। প্রয়োজন বুদ্ধি আর সেই বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ। আজকের নারীরা তাই তাদের ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তারা কাজে-কর্মে প্রমাণ করতে পারছে, তারা কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে কম নয়। তাদের কাজ পুরুষের তুলনায় গোছানো, পরিচ্ছন্ন ও নিপুণ। তারা একাধারে সন্তানের জন্ম দেওয়া, সন্তান প্রতিপালন, সংসারের কাজকর্ম এবং সেই সঙ্গে তাদের শিক্ষা, গবেষণা বা চাকরি সবকিছুকেই দুই হাতে সামাল দিতে সক্ষম। পুরুষ আজও নানা কাজে নারীর মুখাপেক্ষী হয়েই আছে। সুতরাং শ্রেষ্ঠত্ব লড়াইয়ে নারীর জেতার কথা থাকলেও পশু শিকারি পুরুষকূল আজও তাদের শিকারের অভ্যাস, গরিমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই শারীরিক শক্তি প্রদর্শন করে আজও নারীর ওপর তার কর্তৃত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই হঠকারিতার কারণেই অনেক সম্ভাবনাময় নারী তাদের মেধা, বুদ্ধি আর শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারছে না। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের শিকল ভেঙে অনেক নারী আজ বেরিয়ে এসেছে, অতিক্রম করেছে বাধার দেয়াল, টপকে এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। কেউ কেউ আবার এত সব বাধা, প্রতিরোধ, ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা আর তিরস্কার মোকাবিলা করতে না পেরে মনোবল হারিয়ে পুরুষতন্ত্রের কাছেই নিজেকে বলি দেয়। মৃত্যু ঘটে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের।

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে!

আমরা বাঙালি মেয়েরা জন্মের পর থেকে এই সুবচনটি শুনে শুনেই তো বড় হয়েছি। অতীতে প্রতিটি বাঙালির বসার ঘরে শোভা পেত ফ্রেমে বাঁধানো এই বাক্যটি। মেয়েদের সেলাইয়ের হাতেখড়ি হতো রঙিন সুতার নকশা করে ফুল, লতা, পাতার মাঝে এ বাক্যটি তুলে ধরে! সকাল, দুপুর আর বিকেলের প্রতিটি মুহূর্তে যাতে এই বাণীটি আমাদের চিন্তা–চেতনায় ঢুকে যায় এবং বোধোদয় করতে সাহায্য করে—এটাই ছিল তার মুখ্য ও মহৎ উদ্দেশ্য। যুগে যুগে আমরা মাতা, কন্যা, ভগ্নিরা এই অমোঘ বাণী আমাদের হৃদয়ে লালন করে এসেছি। এই বাক্য আমাদের অস্থি মজ্জায় এমন মিশে গেছে যে, একটি সুখী সংসার গড়ার জন্য অন্য পক্ষের ভূমিকা যে সমান গুরুত্বপূর্ণ, তা ভাবতেও আমরা ভুলে গেছি। তাই সব সমস্যা ও অশান্তির দায়ভার আমাদের মেয়েদের ঘাড়ে এসেই পড়ে।

যোগ্যমত স্বামী যদি মিলে তার সনে এই দ্বিতীয় বাক্যটি কিন্তু কখনোই সুই–সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। আমাদের সমাজ ও সমাজপতিরা অত্যন্ত সুকৌশলে সমাজ–সংসারে মেয়েদের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আর ধর্ম তাতে যোগ করেছে আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা। তাইতো ‘সূর্য কন্যারা’ এখনো সমাজ ও ধর্মের এই কঠিন বেড়াজালে বন্দী। এই বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ কথা নয়। যারা চেষ্টা করছে, তাদের পুরুষ পেশি শক্তিকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

মুক্তি কি আদৌ সম্ভব?

‘নারী মুক্তি আন্দোলন’, ‘নারী জাগরণ’—এসব কথা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেই সুদূর অতীতে ফিরে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, তখনকার সেই ক্ষণজন্মা মানুষগুলোর কতো প্রচেষ্টা। তাঁরা গান, কবিতা, গল্পে নারীকে তার শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার আহ্বান আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন । কিন্তু কী হলো? আমরা নারীরা কেউ কেউ আবার নিজেরাই এই শিকলের প্রেমে পড়ে গেছি। এ বন্ধন আমাদের অনেকের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশেও গেছে। শিকলের বাইরের জীবনকে আমরা বড় ভয় পাই। এই শিকল আমাদের অনেকের মূল্যবান গয়নায় পরিণত হয়েছে! অনেকে সারা জীবন পড়ে পড়ে মার খেতেও রাজি। কিন্তু নিজের স্বাধীনতার জন্য একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ‘না’ কথাটি বলতে আজও দ্বিধা করছি। তাই আজও পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশনের খবরে নির্যাতিত, ক্ষতবিক্ষত নারীর জীবিত বা মৃত মুখ দেখতে পাই। অথবা ঘরে-বাইরে দেখতে পাই মানসিক পীড়নের শিকার নারীকে যারা মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় করছে। খোদ মার্কিনরা যেখানে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে এখনো হিমশিম খাচ্ছে, আমরা সেখানে পর পর দুজন প্রভাবশালী নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েও সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। অশিক্ষিত বা অনগ্রসর মেয়েদের কথা না–হয় বাদই দিলাম, অনেক শিক্ষিত মেয়েও স্বাধীন জীবন, পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকার, সমান মর্যাদার দাবি জানাতে ভয় পায়।

বুকের ভেতর কষ্টগুলো দানা বাঁধতে থাকে এই নতজানু চরিত্রের নারী জাতির জন্য। রাগে, দুঃখে আর অপমানে আমার বুক ভেঙে যায়! মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আর কত? ওগো নারী, আর কত মার খাবে? ওগো মেয়ে, আর কতকাল পায়ের নিচে পড়ে থাকবে? এখনো কী সময় হয়নি? স্ত্রীকে মারা জায়েজ কিনা এই আলোচনায় আজকে ২০১৮ সালে এসেও কিছু মেয়ে যেভাবে স্বামীর মেসওয়াকোর বাড়িকে মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে, তা দেখে আমার সত্যি বমি করতে ইচ্ছে করে। ছি! ছি!ছি! কী লজ্জা! কী অপমান! এই অপমানের বোঝা আরও কত যুগ না জানি আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। লাঠি দিয়ে মারা হোক আর মেসওয়াকোর মৃদু আঘাতই করা হোক, অপমানের পাল্লা যে দুটোতেই সমান ভারী, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধিটুকু আজও আমাদের হবে না! হে নারী, জেগে ওঠো! তাকিয়ে দেখো তোমার মতোই আরেকটি মানুষ তোমাকে শাসন করছে, যে কোনো অংশেই তোমার চেয়ে সেরা নয়। পরম পূজনীয় স্বামীটি তার ইচ্ছে মতো স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এমনকি ভুলক্রমে তালাক দিয়ে ফেলে আবার দয়া করে বা আদর করে ফিরিয়ে আনতে চাইলে হিল্লা বিয়ের পদ্ধতির মতো শাস্তিটিও নারীকেই মাথা পেতে নিতে হয়!

অনেক পুরোনো একটি স্মৃতি এখানে শেয়ার করতে চাই, কিছুদিন হল আমাদের এক বন্ধু স্কুলে আসছে না। তার কি হল, জানার জন্য কয়েকজন মিলে ওর বাসায় যাব ঠিক হল। বন্ধু বাসায় গিয়ে সবাই ঘাবড়ে গেলাম, মনে হল মরা বাড়ি! মানুষ মারা গেলেও সেই বাড়ি এত ভয়াবহ নীরব হয় না। বন্ধুর পরিবারের মানুষগুলো যেন পাথর হয়ে গেছে। বন্ধু চুপিচুপি আমাদের তাদের বাড়ির পেছনে নিয়ে এল। তার কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে আমরাও পাথর হয়ে গেলাম। বন্ধুর বাবা কোনো কারণে ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় তার মাকে বলেছেন, ‘বেয়াদব মাগী, যা আজকেই তোকে আমি তালাক দিয়ে দিলাম। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে, তিনি মুখ ফসকে এমন একটি জঘন্য কথা বলে ফেলেছেন। আসলে অন্তর থেকে তিনি তা চান না​। পরে তিনি মসজিদের ইমামের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছেন, এমতাবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে আবার সংসার করার একটিই মাত্র উপায় আছে। তা হল, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে শরিয়ত মতো বিয়ে দিয়ে স্বামী–স্ত্রীর মতো থাকতে হবে। এই দ্বিতীয় স্বামী আবার তালাক দিলে প্রথম স্বামী অর্থাৎ বন্ধুর আব্বা তার আম্মাকে আবার বিয়ে করে সংসার করতে পারবে। বন্ধুর আম্মা সেই থেকে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। মসজিদের ইমাম এবং পাড়ার মুরুব্বিদের অভিমত হল, যেহেতু তালাক হয়ে গেছে তাই ‘হিল্লা’ বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে বসবাস না–জায়েজ হবে। বুকভরা কষ্ট নিয়ে আমরা বাসায় ফিরে এলাম। দুজন নর–নারী একদিন ধর্ম ও সমাজকে সাক্ষী রেখে সংসার নামক যে জীবন শুরু করে, যেখানে দুটি মানুষের সমান অধিকার আর মর্যাদা থাকার কথা, তা বিয়ের অনুষ্ঠানের সেই দামি পোশাক আর গয়নার মতোই একদিন বাক্সবন্দি হয়ে যায়। আটপৌরে জীবনযাত্রায় মেয়েটি হয়ে যায় হুকুমের দাসী, ছেলেটি পরিণত হয় গৃহস্বামীতে। বিবাহ নামক এই বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এক সময়কার প্রেমিক বা বন্ধুটিও রাতারাতি কত বদলে যায়, হয়ে ওঠে স্বামী। এই স্বামী নামটির আড়ালে হারিয়ে যায় একজন বন্ধু, একজন পথচলার সঙ্গী।

আমরা কখনোই জানতে পারি না, ঘরে ঘরে কত গৃহবধূ যে এই মানসিক কষ্টের শিকার হয়েও হাসিমুখে জীবন পার করে দিচ্ছে। সব আশাবাদী মানুষই স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। আমিও স্বপ্ন দেখি, একটি সুখী ও সুন্দর পৃথিবীর! আমাদের ভেতরের পশুকে কোরবানি দিয়ে, আমরা সব মানুষ আবার একসময় সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠব—এটাই প্রত্যাশা!

Admin

Amir hossain is a social article writer. he likes to share knowledge and Interested research content of biodiversity, climate, travel, photography

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form