নতুন বন্ধুত্ব

নতুন নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টির সাথে আমাদের ভেতরে নতুন একেকটি পৃথিবীর জন্ম হয়। আমাদের জীবনে যখন কোনো বন্ধু আসে, তখন আমাদের হৃদয়ে তার জন্য নতুন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়, সে জায়গার নিয়মকানুন, রীতিনীতি আর ধরন হৃদয়ের অন্য জায়গা থেকে ভিন্ন। যখন দুই আত্মা মিলে এক হয়ে যায়, যখন দুইটি ভিন্ন পৃথিবী মিলে এক হয়ে যায়। যখন ভালোবাসা আর সুখের ভিন্ন দুইটি সমীকরণ একীভূত হয়ে যায়। যখন দুইটি হৃদয়ের সুখ ও দুঃখের অনুভূতি আশ্চর্যভাবে একই রকমের হয়ে যায়, তখন বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এ বিচারে পৃথিবীর সবচাইতে ঠুনকো বন্ধুত্ব হচ্ছে, ফেসবুক বন্ধুত্ব। লাইক কমেন্ট শেয়ার চ্যাটিং এর বেড়াজালে হৃদয়ের আবেগ আর অনুভূতি মিথ্যে অনুরণনে চারিদিকে কাঁপতে থাকে। সেই প্রকৃত বন্ধু, যার উপস্থিতি সবসময়ই দারুণ সব স্মৃতির জন্ম দেয়। কোনো প্রতিদানের আশা না করে বন্ধু সবসময়ই বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ায়। সুখের সাথী হোক না হোক, দুঃখের আঁধারে দীপ জ্বেলে যায়। আমরা প্রায়ই পরিচিতকে বন্ধু ভেবে ভুল করি, বন্ধুকে পরিচিত বানিয়ে ফেলে ভুল করি। পরিচিত অনেকেই হতে পারে, কিন্তু বন্ধু হয় কয়েকজন মাত্র। যখন কেউ বিশ্বাস করে, তার প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা তার হাতের আঙুলের সংখ্যার চাইতে বেশি, তখন নিশ্চয়ই তার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বন্ধু এতো বেশি হয় না, খুব দামি জিনিস পরিমাণে সবসময় কম হয়। বন্ধুত্বের ভাষা কোনো শব্দে নয়, বরং অর্থে প্রোথিত। গাছ যেমনি ছায়া দেয় প্রাণ জুড়ায়, বন্ধুত্বও তেমনি নির্ভার নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। স্কুল-কলেজে বন্ধুত্বের পাঠ দেয়া হয় না, এটা এমন এক পাঠ যা জীবনের পাঠশালায় নিতে হয়। এ পাঠ না নিলে অন্য সকল পাঠই নিরর্থক হয়ে যায়। কারো সাথে তখনই বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়, আমরা তাকে হোক ভাল কিংবা মন্দ, ঠিক তেমনভাবেই গ্রহণ করতে পারি। বন্ধু যখন বিপদে পড়ে, তখন সবার আগে বন্ধুই এগিয়ে আসে। বিপদের সময় মানুষ সৃষ্টিকর্তা ও বন্ধুকে ডাকে। নৈরাশ্যের সময়ে বন্ধু পাশে এসে আশার আলো জ্বালে। ভাল বন্ধু আর ভাল মানুষ, একই কথা নয়। কেউ ভাল মানুষ হতে পারে, কিন্তু ভাল বন্ধু নাও হতে পারে। বন্ধুর ভুল থাকবে, দোষ থাকবে, অসম্পূর্ণতা থাকবে, তবুও সবকিছুর পরও বন্ধু বন্ধুই। নিখুঁত বন্ধু যারা খুঁজে বেড়ায়, তাদের জীবনেও কোনো বন্ধু হয় না। কোনো সামাজিক অবস্থান যোগ্যতা, অর্থ-প্রতিপত্তি বন্ধুত্বের নির্দেশক হতে পারে না। তাই ছোটবেলার বন্ধুত্ব সাধারণত কখনোই নষ্ট হয় না। কারণ, ছোটবেলায় কোনো স্বার্থ বা হিসেব-নিকেশ করে বন্ধুত্ব হয় না। আত্মার সাথে আত্মার মিলনে বাল্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এমন বন্ধুত্বই আসল বন্ধুত্ব, যা সারাজীবনই টিকে থাকে।

জাগতিক জীবনে একজন ব্যর্থ মানুষ বন্ধু হিসেবে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যেতে পারে। যখন আকাশ মুক্তো ছড়ায়, রাস্তা ঢাকে, অলিতে গলিতে মুক্তোর স্তূপ পড়ে থাকে, যখন স্বপ্ন এসে দরজায় কড়া নাড়ে, আত্মার মধ্যে মাদকতা জাগায়, যখন পথের ধুলোয় নৈঃশব্দ্য খেলে, যখন বিপুল অরণ্যের স্তব্ধতায় ধূধূ মরুর প্রান্তরে  সন্ধ্যা নামে, রাত্রি উঁকি দেয়- তখন তারার মেলায় ভেসে-ভেসে অপার বিস্ময়ে প্রেমিক প্রশ্ন করে, এমন সুখে থাকে একা? এমন ঐশ্বর্য একাকী গ্রহণ করা কিসের আনন্দ? এ কোন দ্বীপে পড়লাম বাঁধা? নিরন্তর সুখে বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর মিছিলে অমরত্বের এই মিথ্যে ইশারা থেকে কিসে মুক্তি? জীবনের এ কোন ধাঁধায় প্রকট সুখের স্রোতে শান্তি মিলায়? এমন দ্বিধায় সৌন্দর্য-পিপাসু পথিকের অসহায়ত্ব বন্ধুর হৃদয়কে স্পর্শ করে তীব্রভাবে। একটা তারা নেমে আসে আকাশ থেকে, আত্মার সকল বাঁধন একে-একে খুলে যায়, ওই তারাটি কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে- এতো ভাবছ কেন ? তোমার বন্ধু তো আছেই পাশে! তোমার সুখে সঙ্গ দিতে, তোমার দুঃখের ভাগটা নিতে আর কেউ নেই যদিও সে তো আছে। চোখ দুটো বন্ধ হোক, হৃদয়ের আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখো, সে আয়নায় যখন আত্মার ছায়া পড়ে, তখন সকল রহস্যের জট এক-এক করে যায় খুলে। যে মুহূর্তে বন্ধুত্বের আহ্বান হৃদয়ে বাজে, সে মুহূর্তে দুটো আত্মা এক হয়ে যায়। আনন্দ আর বেদনার উৎস অভিন্ন হয়ে ধরা দেয়। অমন মুহূর্তে বন্ধুত্বের শক্তি সকল প্রেমের দায় আর ভালোবাসার দাবিকে হারিয়ে দিয়ে হৃদয়ের একত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সেই তো বন্ধু, যে যুক্তি দিয়ে বিচার করে বন্ধুকে গ্রহণ করে না কিংবা বর্জন করে না। শুধু এইটুকু জানে, বন্ধুকে গ্রহণ করতে হয় হৃদয় দিয়ে, বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে হয় সকল যুক্তিতর্কের ঊর্দ্ধে উঠে, বন্ধুর ভাল মানেই নিজের ভাল, বন্ধুর খারাপ মানেই নিজের খারাপ, বন্ধুর সুখই নিজের সুখ, বন্ধুর দুঃখই নিজের দুঃখ।

তবে হ্যাঁ, আমি যার জন্য নিবেদিত প্রাণ, সে আমার জন্য এতটুকু বন্ধু নাও হতে পারে। সেই বন্ধুত্বই সবচাইতে সুখের শান্তির স্বস্তির, যে বন্ধুত্বে দুইজনই বন্ধুত্বের দাবিতে প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে। বন্ধুত্ব কোনো বোঝা নয়, যা বয়ে বেড়াতে হয়। বন্ধুত্ব সেই শক্তি যা সকল বোঝাকে হাল্কা করে দেয়। আমার যা প্রয়োজন, তার প্রয়োজন অনুভূত হবার সাথে-সাথেই বন্ধু তার খোঁজ দিয়ে দেয়, বন্ধুত্ব এমনই এক অমূল্য উপহার। বন্ধুত্ব প্রত্যাশা করতে জানে না, বন্ধুত্ব কেবলই নিঃস্বার্থভাবে দিতে জানে। বন্ধুত্বের একমাত্র প্রতিদানই হলো ভালোবাসা, আনন্দ, শান্তি। বন্ধুত্ব হতে হলে বিশেষ কেউ হতে হয় না, বন্ধুত্বই ব্যক্তিকে বিশেষ কেউ করে তোলে। আমরা একেবারে সাদামাটা হয়ে পৃথিবীতে আসি, বন্ধুত্বই আমাদের সমৃদ্ধ করে, ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে, বাঁচিয়ে রাখে।

Admin

Amir hossain is a social article writer. he likes to share knowledge and Interested research content of biodiversity, climate, travel, photography

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form