গায়ের রঙ

যাদের চেহারা গায়ের রঙ সুন্দর, আমরা তাদের কাছে টানতে চাই, নিজেদের কাছে রাখতে চাই। সুন্দর চেহারার মানুষ কাছে থাকা মানেই কি নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত, দিন কাটানোর আয়োজন? দুর্দশা কি কখনো মানুষের অবয়ব বুঝে আসে? যারা দেখতে সুন্দর, তারা কি কোনোভাবে কষ্ট থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে? বাহ্যিকভাবে সুন্দর মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার বন্ধু হলাম, তার স্থূল মস্তিষ্কের খোঁজ কিংবা দুষ্কৃত কর্মের প্রবৃত্তি না জেনেই। আর কোনো এক সময় তার পাপ কিংবা নির্বুদ্ধিতার শাস্তি আমাকেও পেতে হলো। এমনও তো হতে পারে, তাই না? বন্ধুর পুণ্যের ভাগ না পেলেও বন্ধুর পাপের পরিণতি প্রায়ই ভোগ করতে হয়। বিপদ এবং দুর্ভাগ্য সবচাইতে সুন্দর মানুষটিকেও এক ইঞ্চিও ছাড় দেয় না। বরং অবয়বের সৌন্দর্য মানুষকে প্রায়ই বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। চর্যাপদ শেখায়, আপনা মাংসে হরিণা বৈরি। হরিণ যেমন তার সুস্বাদু মাংসের জন্যই শিকারিদের সবচেয়ে প্রিয়, তেমনি সুন্দর চেহারা আর গড়নের মানুষও সহজেই সবার শত্রু হয়ে ওঠে।

সুন্দর মানুষ যার শত্রু, সুন্দর মানুষের বন্ধুও তার শত্রু। বাইরের সৌন্দর্যের দাস না হয়ে ভেতরের সৌন্দর্যের পূজারি হয়ে জীবন কাটালে কারো শারীরিক সান্নিধ্য থাকুক না থাকুক, তার হৃদয়ের কাছাকাছি বসবাস করেও শান্তিতে জীবন কাটানো যায়। দাসত্বের শেকল মানুষকে অন্ধ করে দেয়, আর নিবেদনের স্পর্শ মানুষের দেবত্বকে জাগ্রত করে। যে দুঃখ আমাদের কাঁদায়, সে দুঃখের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকালে আমরা দেখতে পাবো, প্রকৃতপক্ষে সে দুঃখের মধ্যে অনির্বচনীয় সুখের ফোয়ারা লুকানো রয়েছে। গান যে আমাদের মুগ্ধ করে, সে মুগ্ধতার কৃতিত্ব যতটুকু না গানের কথার, তার চাইতে বেশি গানের সুরের। সুরই অজানা ভাষার গানের প্রতিও প্রেমের জন্ম দেয়। একইভাবে হৃদয় যদি সুরে ভেসে যায়, তবে সুখ কিংবা দুঃখ যা-ই হৃদয়ে আসুক না কেন, হৃদয় ঠিকই সুন্দর সুরে বাজতে থাকে। ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ, দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য, আনন্দ কিংবা বেদনা, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা, এরূপ বৈপরীত্যের কোনটাই অগ্রাহ্য করার মতো তুচ্ছ নয়। কখনো দেখা যায়- বেদনাও সুরের উপর ভর করে হৃদয়কে আনন্দে মাতায়। আমাদের হৃদয়ে আনন্দের যে বিস্তৃত প্রস্রবণ চির প্রবহমান, যদি আমরা তার বিন্দুমাত্রেরও খোঁজ কখনো পেতাম, তবে পৃথিবীর কোনো দুঃখই আমাদের আর বিহ্বল করে দিতে পারত না। দুঃখকে খুব সহজেই গ্রহণ করে সে আনন্দের ধারায় হাসিমুখে মিশিয়ে দিতাম। হৃদয়ের ভেতরের পৃথিবীর খোঁজ যে একবার পেয়েছে, সে আর বাইরের পৃথিবীর রঙের নেশায় তৃষ্ণার্ত হয়ে ছুটে বেড়ায় না। সুন্দরের আবেদন যথার্থভাবে গ্রহণ করতে হলে শিশুর হৃদয় দিয়ে সুন্দরের দিকে তাকাতে হয়। শিশুরা নিষ্পাপ বলে যতো সহজে সৌন্দর্যতে মুগ্ধ হয়ে থাকে, অন্যরা ততো সহজে সৌন্দর্যের সাগরে অবগাহন করতে পারে না। সুন্দর যতো বেশি ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণে ভারাক্রান্ত হয়, সুন্দর ততো বেশি তার আবেদন হারায়। হৃদয়ের অপার সৌন্দর্যের মধ্যে ডুব দিতে নির্বোধ, সরল, সহজ হতে হয়। যার মধ্যে পার্থিব বুদ্ধি যতো বেশি, সে সুন্দর হতে ততো দূরে। জাগতিক অর্জনের সাথে সাথে হৃদয়ের ঐশ্বর্য কমতে থাকে। যখন হৃদয় পার্থিব হিসেবের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, তখন ঐশ্বরিক আলোর ধারা হৃদয়কে আর ধুয়ে দেয় না, অনন্ত আঁধার হৃদয়ে তার রাজত্বের সূচনা করে।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form