মানুষের জীবন সংগ্রাম

জীবন সংগ্রাম

প্রচন্ড গরমে রৌদ্র মাথার উপর নিয়ে হেঁটে চলেছি। তবে পাশের সব ব্যস্ত মানুষদের মত আমার মাঝে নেই কোনো ব্যস্ততা।আনমনে হেঁটে চলেছি, উদ্দেশ্যহীন এই পথচলা। তবে একেবারে উদ্দেশ্যহীন তা বলা যাবে না। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে এই চলা। বাস্তবতা অনেক কঠিন ও নির্মম। এখানে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়। সেই সংগ্রামে যারাই কিছুটা ঝিমিয়ে পড়বে, তারাই হারিয়ে যাবে কালের অতল গহ্বরে। তবে সেদিন আমি সেই সংগ্রামী মানুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। নিজেকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে ছিলাম। চলার পথে আমার চোখে পড়ে অনেক বাস্তবতা। হাজার মানুষের ব্যস্ততার মাঝে কিছু মানুষ পথিকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে রেখেছে কিছু পাওয়ার আশায়। কেউ হয়ত কিছু দিচ্ছে, কেউবা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে। কেউবা অবান্ঞ্চিত ভাষায় গালিও দিচ্ছে। তবুও ঐ মানুষগুলো হাত নামায় না। তারা হাত পেতে অপেক্ষায় থাকে একজন হৃদয়বান মানুষের অপেক্ষায়। এটাই তাদের জীবন সংগ্রাম। এসব দেখতে দেখতে আমি পথ চলতে থাকি। চলতে চলতে চোখে পড়ে কিছু কিশোর-কিশোরী। লোকে যাদের টুকাই নামে সবাই চিনে। পথের টুকাইরা বড্ড নোংরা, হয়ত সপ্তাহেও একবারও গোসল করে না। কাপড় বলতে হয়ত পরনে বড়জোর একটা হাফপ্যান্ট। তাও মাত্রাতিরিক্ত ময়লাযুক্ত। কিন্তু তবুও কেন যেন এই টুকাই নামের কিশোর-কিশোরীদের উপর খুব মায়া হয়। কিছু কাগজ, মানুষের ফেলে দেয়া প্লাস্টিক এসব তুলে নেয়ার জন্য তারা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় অলি-গলি, রাস্তা আর পার্কে। রৌদ্রের তাপে তাদের চেহারা কালো হতে থাকে। খালি গায়ে শরীরের চামড়া গুলো ঝলসে যায়। তবুও তারা পিছপা হয়না। এটাই তাদের জীবন সংগ্রাম।

এসব দেখেও আমি থামতে পারি না। কারণ আমি জানি জীবনটা এমনি। অদ্ভুত সব মানুষের সমষ্ঠিতে গঠিত জীবন। আমি আরও এগিয়ে চলি। আমার চোখে পড়ে জীবনের আর এক অদ্ভুত মানুষের। মধ্য বয়সি এক বৃদ্ধ ঠেলা নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য! আমার ইচ্ছে করে ঐ লোকটাকে একটু সাহায্য করতে। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে বাঁধা দেয়। বৃদ্ধলোকটির শরীরে অপর্যাপ্ত মাংস। চামড়ার ভিতর থেকে হাড় গুলো ভেসে উঠেছে। শক্তিহীন পেশি দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি খরচ করে এগিয়ে চলছে বৃদ্ধ। এই বৃদ্ধ সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ। তার পরিবারের এমন দূরবস্থা যে, এই বয়সে তাকে এত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে তার কাছে গিয়ে পিছন থেকে ঠেলা ঠেলতে সাহায্য করতে থাকি। নিজের কাজের কিছুটা হালকা অনুভব করে বৃদ্ধ পিছনে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারে না। ছোট করে একটা হাসি দিয়ে বলি- চাচা, পিছনে তাকাতে হবেনা। আমি ধাক্কা দিচ্ছি, আপনি সামনে দেখে চলেন, পরে কথা বলা যাবে। আমার কথা শুনে বৃদ্ধ আর কথা বলে না, চুপ চাপ এগিয়ে চলে। চোখে তার কয়েক ফোঁটা জল চিক চিক করছে। অবশেষে এক প্লেট মুড়ি আর কিছু গুড় নিয়ে বৃদ্ধলোকটি সামনা-সামনি বসা। বিস্মিত নয়নে বৃদ্ধের কুঠুরি দেখছি। কিছুক্ষন পূর্বে পনের বছর বয়সের একটি মেয়ে এসে কিছু মুড়ি গুড় দিয়ে যায়। ঐ মেয়ে আর বৃদ্ধলোকটি ছাড়া এ ঘরে আর কেউ থাকে বলে মনে হয় না। এক মুঠো মুড়ি আর সামান্য গুড় মুখে দিয়ে বলি- চাচা আপনার পরিবারে আর কেউ নেই? কথাটা শুনে বৃদ্ধের মুখখানি একদম শুকিয়ে যায়। চোখের কোনে জমে উঠে কয়েক ফোঁটা জল। মনে হয় দুঃখের স্মৃতি গুলো কুড়েকুড়ে খাচ্ছে থাকে।কিছুক্ষনের জন্য একদম নির্বাক হয়ে যায় তিনি। তারপর শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বলতে থাকেন- আমারও সুন্দর একটা সংসার ছিল। দুই ছেলে আর একটি মেয়ে আমার। অনেক কষ্ট করে ছেলেদের লেখাপড়া করিয়ে বড় অফিসার বানাই। কিন্তু তারপর তারা বিয়ে করে যার যার মত চলে যায়। আর বছর খানেক আগে আমার স্ত্রী পরলোক গমন করেছেন। এখন আমি আর এই আমার মেয়ে। আমার খুব চিন্তা হয় আমার মেয়েকে নিয়ে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়, আমার এই মেয়েটি একেবারে অসহায় হয়ে যাবে। কথা গুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধ।
জীবন সংগ্রাম

মানুষ কেন এতটা স্বার্থপর হয়! নিজের জীবনটাকে উপভোগ করাটাই কি জীবন? অদ্ভুত এই মানুষদের মন বুঝা অনেক কঠিন। ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের দরজায় দাড়িয়ে বৃদ্ধের হাত ধরে বলি- চাচা আজ থেকে আমাকে আপনার ছেলে ভাবতে পারেন। আমি জানি, আমি আপনাদের জন্য কিছু করতে পারব না। তবে অন্তত এটা ভাবতে পারেন আপনার একটি ছেলে রয়েছে, যে আপনাদের বিপদে পাশে থাকবে। আর আপনার মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। তার ভাই তার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। আমি আবার আসব।

এই পরিবারের জন্য আমি তেমন কিছুই করতে পারবো না। তবুও শান্তনা এই যে, এই বৃদ্ধ আর মেয়েটি একটি অবলম্বন হিসেবে ভরসা করতে পারবে। তবে আমি অবাক হয় যে, কত সহজ সরল এই বাঙ্গালি দরিদ্র মানুষজন চেনেনা, জানেনা এমন একটি ছেলেকে মহুর্তেই কেমন আপন ভেবে বিশ্বাস করে নিলো। দরিদ্র মানুষগুলোর এই বিশ্বাস আর সরলতাই তাদের পায়ে কুঠার আঘাত হানে। তারা রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে ঠকে। তারা বড়লোক মনিবকে বিশ্বাস করে ঠকে। নিজের শিক্ষিত সন্তানও তাঁদের ঠকায়। এই রাষ্টের কাছ থেকেও তাঁরা ঠকে। সবাই তাদের ঠকিয়ে যায় তবুও তাঁরা কিছু বলে না। বলার মত, প্রতিবাদ করার মত শক্তি তাদের নেই। আছে অত্যাচার সইবার শক্তি। হয়ত এটাই তাদের জীবন সংগ্রাম।full-width

Admin

Amir hossain is a social article writer. he likes to share knowledge and Interested research content of biodiversity, climate, travel, photography

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form