হারিকেন এখন অতীত স্মৃতি

হারিকেন ঝড় বৃষ্টিতে নিভে যায় না এমন কাচের ঢাকনাযুক্ত কেরোসিন তেলের লন্ঠন বা বাতি। একটা সময় ছিল গ্রাম বাংলা মানেই হারিকেন আর কুপি। গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে ঘরে এক সময় আলোর অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো হারিকেন। আবার অনেক সময় সবার ঘরে হারিকেন পাওয়া যেত না। কারণ সাধ আছে সাধ্য নেই। এমন পরিস্থিতিও ছিল এ সমাজের মানুষের ঘরে ঘরে। কিন্তু বর্তমানে এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিটি ঘরের চিত্রটাই তেমনি পাল্টে গেছে। গ্রামীণ সমাজের সন্ধ্যা বাতি হারিকেন এখন অতীত স্মৃতিতে পরিনত হয়ে গেছে। এখন আর কোনো ঘরে কিংবা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হাজার বছরের ঐতিহ্যের বাহন সেই হারিকেন এখন আর চোখে পড়ে না। অথচ এখন থেকে দুই দশক আগেও যেখানে বেশিরভাগ ঘরেই ব্যবহার হতো হারিকেন আর দুই দশক পরে এসে সেইরূপ এখন পুরোটাই পরিবর্তিত হয়েছে। দুই দশক আগেও চিত্রটি ছিল এমন যে, সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে সাঁঝের বেলায় নারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন সন্ধ্যায় ঘরের আলো জ্বালানো নিয়ে।
হারিকেন এখন আর চোখে পড়ে না | আমির হোসেন
প্রতি সন্ধ্যায় হারিকেনের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ছিপি খুলে কেরোসিন তেল ঢেলে আবার ছিপি লাগিয়ে রেশার মধ্যে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে তা নির্দিষ্ট সীমারেখায় রেখে ঘরের মেঝে জ্বালিয়ে রাখত। ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা ও কিছুটা ছড়াকারের মত এক ধরনের কাপড় রেশা হিসেবে ব্যবহার করা হতো এতে। এটার আলো কমানো ও বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট একটি গিয়ার ছিল। হাতের সাহায্যে তা ঘুরিয়ে আলোর গতিবেগ কমানো ও বাড়ানো যেতো। রাতে ঘুমানোর সময় আলো কমিয়ে সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হতো। তাছাড়াও কুপি ছিল কয়েক প্রকার। একনলা, দুইনলা, একতাক, দুই তাকের, পিতল ও সিলভারের। তবে সিলভার, টিন এবং মাটির তৈরি বাতির ব্যবহার ছিল খুব বেশি। বাতির নলে আগুন জ্বালানোর জন্য রেশা হিসেবে ব্যবহার করা হতো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো কিংবা পাটের সুতলি। চিকন আর লম্বা করে ৫-৬ ইঞ্চির দৈর্ঘ্যের ওই রেশা বাতির নল দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো। প্রতিদিন এর কিছু অংশ জ্বলে পুড়ে যেত। ফের পরের দিন আবার একটু উপরের দিকে তুলে দিতো। এক পর্যায়ে তা পুড়ে গেলে আবার নতুন করে লাগানো হতো। বাজার থেকে ২-৫ টাকায় ওই বাতিগুলো কিনতে পাওয়া যেত। কিছুদিন পর নিচ দিয়ে ফুটো হয়ে তেল পড়ে যেত। ফের নতুন একটি বাতি বাজার থেকে কিনতে হতো। এটা ছিল নারীদের সন্ধ্যাবেলার দৈনন্দিন কাজের বিশেষ একটি অংশ। এই বাতি দিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতো। এছাড়াও রাতের সকল কাজ, যেমন রান্না-বাড়া, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, ধান মাড়ানোসহ সকল চাহিদা মেটানো হতো এই আলো দিয়ে। বর্তমানে গ্রামীণ সমাজের প্রতিটি ঘরে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে। যেখানে ছিল না কোন বৈদ্যুতিক লাইট, পাখা, এয়ার কন্ডিশানসহ আরো অনেক কিছু। বর্তমানে বিদ্যুতায়নের ফলে সবকিছুর স্বাদ গ্রহন করছে গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা। এখন দিনের বেলায়ও আলো জ্বালাতে হয়। এখন আর শুধু বিদ্যুতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ার জন্য আইপিএস ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউবা আবার সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। হাত পাখার বদলে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ার কন্ডিশান ব্যবহার করা হচ্ছে। একসময় বাড়িতে কেরোসিন তেল দিয়ে হারিকেন, কুপি জ্বালানো হতো। হ্যাজাক জ্বালিয়ে গ্রামাঞ্চলে বিয়ে-সাদীসহ রাতের নানা অনুষ্ঠান করা হতো। সে সময় ডাকপিয়নরা চিঠির বোঝা পিঠে করে হাতে হারিকেন নিয়ে গন্তব্যে যেত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলে গ্রামবাংলার সেই হারিকেন আজ বিলুপ্তির পথে। ইলেকট্রিক বাতি, চাজার্র ও সৌর বিদ্যুতের নানা ব্যবহারের ফলে সেই হারিকেনের ব্যবহার আজ আর দেখা যায় না।
হারিকেন এখন বিলুপ্ত | আমির হোসেন
হারিকেন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিদ্যুৎ নেই এমন গ্রামেও এখন চাজার্র ব্যবহার বাড়ছে। এখনও হয়তোবা দু’এক বাড়িতে হারিকেন পাওয়া যেতে পারে কিন্তু দেখা যাবে সেগুলো ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখন শুধু হারিকেন, ডিমলাইট ও ল্যাম্প নয়, সময়ের সাথে সাথে এসবের কাচের চিমনি ও সলতে হাট-বাজারের দোকানগুলোতেও খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form