আবার তুমি মানুষ হও

পৃথিবীতে ১৮ হাজার মাখলুকাত রয়েছে। এই ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্যে রয়েছে মানুষ, পশু, পাখি, জীব, জন্তু, জানোয়ার ইত্যাদি। পশু পাখির মধ্যে কোনটি হিংস্র, কোনটি নিরীহ, কোনটি মাংসাশী আবার কোনটি তৃণভোজী। সৃষ্টকুলের মধ্যে জীব, জন্তু, পশু, পাখি সকলেই তাহাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা ধারণ করিয়া আছে। মনুষ্য সমাজের নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন আইন আছে, মনুষ্য সমাজ যেমন আইনের অধীন, তেমনিভাবে অন্যান্য প্রাণীকুলও একটি নির্দিষ্ট আইনের অধীন। অন্যান্য প্রাণীকুল তাহাদের জন্য নির্দিষ্ট আইন যথাযথভাবে মান্য করিয়া চলে। এজন্যই বোধহয় আমরা কেহই শুনি নাই যে, কেহ বাঘ কে বলিতেছে- “বাঘ আবার তোরা বাঘ হ”, “সিংহ আবার তোরা সিংহ হ” বা “গাধা আবার তোরা গাধা হ”। এই আঠারো হাজার মাখুলুকাতের মধ্যে মানুষ হইল সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।

আবার তুমি মানুষ হও

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আবার এই মানুষই হলো- সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব। মানুষ তাহার কর্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি জগতের মধ্যে সেরা হতে পারে। আবার কর্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা মনুষ্য জাতী সৃজন করে দেখিয়েছেন সত্য ও ন্যায়ের পথ। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে ন্যায়ের পথে চলতে পারে আবার অন্যায়ের পথেও চলতে পারে। মনুষ্য বৈশিষ্ট্যের উথান-পতন আছে। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো যে মানুষের মধ্যে দয়া, মায়া, মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, সততাসহ যাবতীয় ইতিবাচক গুণাবলীর সমাহার ঘটিবে। এই গুলো হলো মনুষত্যবোধ। আর এজন্যই মানুষের মনুষত্যের পতন ঘটিলেই আমরা বলিতে থাকি মানুষ হও। ইহার মানে হলো তোমার মধ্যে দয়া, মায়া, মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, সততা ইত্যাদি গুণাবলীর অনুপস্থিতির কারণে তুমি এখন মনুষ্য সজ্ঞার বাইরে অবস্থান করিতেছ। তোমার মধ্যে দয়া, মায়া, মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, সততার গুণাবলী জাগাইয়া তোল। আবার তুমি মানুষ হও।


যদিও আমরা কাগজে কলমে দাবী করি আমরা সভ্য সমাজে বসবাস করিতেছি। কিন্তু আসলেই কি তাই? আমরা কি আসলেই সভ্য সমাজে বসবাস করিতেছি? যদি আমাদের বর্তমান সমাজকে সভ্য সমাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, তাহা হইলে বোধহয় সভ্যতার সংজ্ঞা আবার নতুন করিয়া আমাদের লিখিতে হবে। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করিতে পারিবেন যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করিতেছি তাহা মোটেও সভ্য সমাজ নহে। অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, নোংরামির এই সমাজকে আমরা কোন মুখে সভ্য সমাজ হিসেবে আখ্যায়িত করি? সভ্য সমাজ হতে হলে আগে মানুষকে মানুষ হয়ে উঠিতে হয়। প্রশ্ন জাগে আমরা কি মানুষ হয়ে উঠিতে পারিয়াছি? আমরা আজও মানুষ হয়ে উঠিতে পারি নাই। মানুষ হতে পারি নাই বলে কেহ দামী খাবার অপচয় করিয়া ডাস্টবিনে ফেলে দেয় আর কেহ সেই খাবার ক্ষুধার তাড়নায় ডাস্টবিন হতে কুড়াইয়া খায়। মানুষ হতে পারি নাই বলে গর্ভবতী পাগলী মা প্রসব বেদনায় ডাস্টবিনে পড়ে ছটফট করিতে থাকে আর আমরা তাহাকে সাহায্য করার বদলে আমাদের মনুষত্যবোধকে কবর দিয়ে তাহা নির্বিকার চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেও লজ্জাবোধ করিনা। মানুষ হতে পারি নাই বলে ঘুষের টাকা না দিতে পারায় গর্ভবতী মাকে আজও হাসপাতালের বাইরের রাস্তায় জনসম্মুখে বাচ্চা প্রসব করিতে হয়। মানুষ হতে পারি নাই বলে আমাদের ছোট্ট দুধের শিশুটি, আমাদের নব্বই ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা দাদী নানী, আমাদের মা বোন স্ত্রী কোন পুরুষ নামক জানোয়ারদের লালসার শিকার হয়। মানুষ হইতে পারি নাই বলে আজও কোর্ট কাচারির দ্বারে দ্বারে বিচারের বানী কাদেঁ। মানুষ হতে পারি নাই বলে কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর রাগে দুঃখে ক্ষোভে লিখিয়া গিয়াছেন 

“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।”

দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাঙ্গালী থেকে আমরা বাংলাদেশি হয়েছি, সাত কোটি জনগণ আজ ১৮ কোটিতে রুপান্তরিত হয়েছে, তথ্য প্রযুক্তিতে দেশ অনেক এগিয়ে কিন্তু আজও আমরা মানুষ হইতে পারিনি। মনুষ্য সমাজ হইতে মনুষ্যত্ববোধ যেন চিরতরে বিদায় নিয়াছে। মানুষের প্রতি মানুষের মায়া, মমতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, দায় দায়িত্ববোধ এখন আর দেখা যায় না। এজন্যই বোধ হয় ভূপেন হাজারিকা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছিলেন- 

“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…ও বন্ধু।”

সমাজব্যবস্থা যদি বস্তুবাদী, ভোগবাদী হয়, তাহা হলে মানুষও ধীরে ধীরে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী হয়ে উঠে। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয় তাহা হলে ঐ সমাজের মানুষও ধীরে ধীরে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। মানুষ নিয়ে সমাজ গঠিত হয়, মানুষের দ্বারাই রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেই মানুষ, মানুষ না হলে সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাল হবে কিরূপে? আমাদের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আশংকা জনক ভাবে স্বৈরাচারী হয়ে পড়েছে। এখন কেউ কারো কথা মানতে চায় না। কেউ কাউকে সম্মান, মর্যাদা দিতে চায় না। মানুষ এখন খুব বেশি পরিমানে স্বার্থবাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়েছে। মানুষের মধ্য থেকে পাপবোধ, মানবতাবোধ বিলুপ্তির পথে। সমাজের প্রত্যেক স্তরে দুর্নীতির পোকা ঢুকে সাধারণ জনগণকে কুড়ে কুড়ে খাইতেছে। এমন কোন সরকারী দফতর নাই যেখানে ঘুষে ছাড়া সেবা পাওয়া যায়। এমন কোন সরকারী দফতর নাই যেখানে সাধারণ মানুষ হেনস্তার শিকার হয় না।


সমাজব্যবস্থার শিরায় উপশিরায় আজ দুর্নীতির বীজ বপন হয়েছে তাহা সুস্থ মস্তিষ্ক সমপন্ন ব্যক্তি মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। দেশের উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন করতে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সত্তর ভাগ টাকা দুর্নীতিবাজদের পকেটে চলে যায়। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন করতেই অর্ধেকের বেশি টাকা গায়েব হয়ে যায়। 

                 

সমাজের মহৎ পেশা গুলোর মধ্যে ডাক্তার, শিক্ষক, আইন পেশা গুলো সর্বাগ্রে দেখা হয়। কিন্তু ডাক্তারের নিকট সাধারণ জনগণ ডাকাতির শিকার হয়। ডাক্তারের নিকট গেলে যদি তেমন কিছু নাও হয় তবু ডাক্তার চার পাচঁটি টেস্ট হাতে ধরিয়ে দিবেন। পরে ঐ টেস্ট থেকে তিনি কমিশন খাবেন। কমিশন খাওয়া ডাক্তার গুলো আজেবাজে কোম্পানির ঔষধ সাজেস্ট করিয়া থাকে। আবার ডাক্তারের সাজেশন মত ঔষধ কিনিতে গেলে ভেজাল ঔষধ পাওয়া আজকাল নিত্যদিনের ব্যাপার। গর্ভবতী মাকে ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে গেলে সিজার করার প্রয়োজন না হলেও টাকার লোভে সিজার করিতে বাধ্য করানো, সরকারি হাসপাতালে টাকা দিলে সীট পাওয়া না দিলে ফ্লোরেও যায়গা না হওয়া, বেওয়ারিশ লাশের সন্ধানে হাসপাতালে গেলে লাশ না দিয়া ভুল বুঝাইয়া ঐ লাশের কংকাল বিক্রির ব্যবসা করা, সরকারি হাসপাতালে রোগীর আত্বীয় স্বজনদের মারধর করা এখন সাধারণ ব্যাপার। প্রতিবাদ করিতে গেলেই কর্মবিরতি দিয়া ডাক্তার সমাজ আন্দোলন করে জনগণকে হয়রাণীর সাগরে ডুবাইতে থাকেন।

             

ভুক্তভোগী জনগণ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে উকিলের কাছে গেলে উকিল তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করিয়া মোয়াক্কেলের পকেট থেকে টাকা খসাইয়া তাহাদেরকে আরো বেশি সমস্যার ভিতরে ফেলিতে কার্পণ্য করেন না যাহাদের হাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেই আইনজীবীরাই নিজ নিজ মোয়াক্কেলের সহিত অবিচার করিতে দ্বিধাবোধ করেন না। যে শিক্ষকদেরকে আমরা জাতী গড়ার কারিগর বলে থাকি তাহাদের হাতেই যখন আমাদের সন্তানেরা ধর্ষিত হয়, তাহারা যখন শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করিয়া রমরমা কোচিং ব্যবসা করিতে থাকেন, যখন প্রশ্নফাস করে জাতীকে মেধাশুন্য করার চক্রান্ত করে তখন লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু করতে হয়। যে ছাত্র শিক্ষগুরুর পায়ে হাত দিয়া আশীর্বাদ নিতেন, সম্মান করিতেন, সেই ছাত্ররাই আজ শিক্ষককে জিম্মি করে মারধর করে। অপমান করে। ছাত্রদের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার কথা, তাহারা আজ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানী, সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করে।   


নারীদের স্বাধীনতা দেওয়ার নামে পণ্য বানিয়ে টিভি, সিনেমা, নাটক, গান, বিজ্ঞাপনে নোংরামি উপস্থাপন করা হয়তেছে। আমাদের সমাজ থেকে লজ্জা শরম দিনে দিনে উঠে যাচ্ছে। পারিবারিক ভাঙ্গন এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগেও কত ছন্দময় ছিল জীবন। পরিবারের একের সাথে অন্য সদস্যদের কত ভাল সম্পর্ক ছিল। কখনো সবাই মিলে গঠনমূলক আলোচনায় শিশুরা আপনজনের নিকট হতে হাতে নৈতিক শিক্ষা গ্রহন করতো। সদস্যদের মাঝে পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় হতো। পরপুরুষ দেখলে মা-বোনরা ঘোমটা ঢেকে মুখ লুকাইত। মানুষের মাঝে মায়া মমতা, একে অপরের প্রতি সহমর্মিতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহজ সরলতাপূর্ণ জীবন যাপন ছিলো। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই দিনগুলো? আগে এক বাড়িতে মানুষ মরলে দশ গ্রামে শোকের মাতম বয়ে যেত। এখন কোন বাড়িতে মানুষ মরলে পাশের বাড়িতে গান বাজনা চলতে থাকে। কোন বাড়িতে ওয়াজ মাহফিলে লোক হয় না কিন্তু পাশেই চায়ের দোকানে লোকে লোকারণ্যে টিভি দেখায় তাহারা মত্ত থাকে। দিন যতো যাইতেছে ততই আমরা যান্ত্রিক হয়ে যায়তেছি। আমাদের মনুষ্যত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে আমরা আজ অমানুষে পরিণত হয়েছি। তাইতো প্রশ্ন জাগে, আবার কি মানুষ হতে পারবো? অপরাধ প্রবণ এই সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শক্ত আইন আছে। কিন্তু এই সব আইনকে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করা হয় না বলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আজ বেহাল দশা। তাছাড়া আছে ধর্মীয় আইন। ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের ভেতরে জাগ্রত না হলে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠা সম্ভব না। তাই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইন সচেতন সমাজ তৈরি এখন সময়ের দাবি।


Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form