আমরা কি প্রকৃত মানুষ? প্রশ্নটি যত সহজ, উত্তর তত সহজ নয়। বরং জটিল এর উত্তর। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের জানা প্রয়োজন একজন প্রকৃত মানুষ হতে হলে তার মাঝে কি কি বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন।
নিজেকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে হলে সর্বপ্রথম নিজের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হবে। অন্তরচেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। বর্তমান সমাজে মানুষ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক। তারা সর্বদাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তারা নিজের বৈষয়িক চিন্তায় এতই মগ্ন যে, অন্যের সুখ-দুঃখ নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের থাকে না। মানুষের এ স্বার্থান্বেষী চিন্তাধারার জন্য তারা মানুষের প্রকৃত রূপ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদের চাই পরস্পরের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা, চাই স্নেহ, করুণা, স্বার্থপরতাহীনতা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কিভাবে চলছে হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি পাপকর্ম। এটাই কি প্রকৃত মানবের মনুষ্যত্বের পরিচয়? হজরত মোহাম্মদ (সা;) বলেছেন-
‘‘যে ব্যক্তি সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং মানুষকে ভালোবাসে, সে প্রকৃত মুসলমান।’’
অর্থাৎ এমন এক মানুষের কথা বলা হয়েছে, যার অন্তরে থাকবে পরস্পরের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন-
‘‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বরে।’’
অর্থাৎ তাঁর মতে প্রাণ মাত্রই ঈশ্বরের সমতুল্য। কিন্তু বর্তমান মানবসমাজের গতি তার উল্টো দিকে। বর্তমানে মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। বর্তমান জগতে মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দেখা যায়, তা অতি কৃত্রিম। তাতে থাকে না কোনো আন্তরিকতা, থাকে শুধু কপটতা আর স্বার্থপরতা। এ ভালোবাসা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বর্তমানে এ জগতের রথ চলছে মিথ্যা ও ছল নামক ইন্ধনের দ্বারা। এ রথে যারা চলছে, তাদের প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। তাদের ভণ্ডামির জন্য বর্তমান মানবসমাজ ধূলিসাৎ হচ্ছে। এ ধূলিসম অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য চাই প্রকৃত স্নেহ ও ভালোবাসা, যার দ্বারা আমরা এ বিশ্বের মানুষের মন জয় করতে পারব। একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার জন্য নিজের ভাবাধারার পরিবর্তন ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। যে ব্যক্তি জগতের সব ব্যক্তিকে নিজের বন্ধু, ভাই, পিতা ও নারীদের নিজের বোন, মা হিসেবে দেখেন, সে ব্যক্তিই প্রকৃত মানুষ। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশই স্বার্থপর। এ কারণেই বর্তমানে মানুষ অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যতই উন্নতি করি না কেন, প্রকৃত মানুষ না হতে পারলে এ উন্নতির কোনো মূল্য নেই।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া এ মনুষ্যত্ববোধ ও চারিত্রিক গুণাবলি ফিরিয়ে আনতে দরকার পারস্পরিক সম্প্রীতি। পরিতাপের বিষয় আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি মানুষের প্রতি আচরণে ঘৃণ্য বর্বরতায় মেতে উঠেছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর কলঙ্ক লেপন করছে। মানবিকতাকে করছে পদদলিত। যারা মানবিকতাকে অস্বীকার করে শুধু ধর্মের প্রচলিত যুক্তিহীন আচার-অনুষ্ঠানে ও বিশ্বাসে দায়বদ্ধ থাকে, তারাই মৌলবাদী। কোনো কোনো দেশের মৌলবাদীরা নিজ স্বার্থেই অন্ধ অনুগামীদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণু করে তুলছে। মৌলবাদীদের প্ররোচনাতেই সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ উগ্র রূপ ধারণ করছে।
মনুষ্যত্বহীন মানব পানিবিহীন সাগরের মতো। পানিহীন সাগরের যেমন পরিচয় পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি মনুষ্যত্বহীন মানুষেরও কোনো পরিচয় নেই। মনুষ্যত্ব আমাদের অন্তরের বিষয়। আর এ অভ্যন্তরীণ বিষয়কে জাগ্রত করতে আমাদের চাই আন্তরিক ইচ্ছা। এ মনুষ্যত্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের চাই মানসিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, যা আমাদের প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে ও বিভিন্ন বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে। এ সংগ্রামে জয়ী হলেই আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারব।
এ জগতের বাহ্যিক রূপ অতি সুন্দর কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ রূপ বড়ই জটিল। অনেক সময় বিভ্রান্তিকর মরীচিকার মতো। মানুষও জগতের মতোই। তারা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, লিপ্সা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অন্যকে মিথ্যা প্রলোভনে বিভ্রান্ত করে। এটি মনুষ্যত্ব নয়। এটি ভীষণ পরিতাপের বিষয়। সময় থাকতে আমরা যদি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারি, তাহলে আমাদের পতন নিশ্চিত। এ পতন থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে আমাদের অন্তর-আত্মাকে উন্নত করতে হবে। আমাদের স্বার্থপরতা বিসর্জন দিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। তা হলেই মিলবে আমাদের মুক্তি, নতুবা আমাদের মানব-অধিকার নিরর্থক।
প্রতি দিন নতুন সূর্যের আলো নতুন আশা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। তাই আশা হারানো যাবে না। অবক্ষয়ই একমাত্র সত্য নয়। আশা রাখার মতো আরও অনেক কিছুই রয়েছে। ভবিষ্যতের মানুষ এই আশার পালে জোর হাওয়া দেবে; একদিন এ পৃথিবীকে নতুন রূপে, নতুন চিন্তাধারায়, সত্যিকারের মনুষ্যত্বে উজ্জীবিত প্রকৃত মানুষের রূপে ভরিয়ে তুলবে। এ জন্য চাই মনুষ্যত্বের জাগরণ। এ জাগরণের জন্য চাই প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা। যার মাধ্যমে আমরা নিজের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে পারি এবং তারই মাধ্যমে এক প্রকৃত মানব সমাজ গড়ে তুলতে পারব। ভবিষ্যতের এ আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে সদ্যোজাত শিশুই আমাদের আগামী দিনের দিশারি। তাদের উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এ কলুষিত জগৎ একটি নির্মল স্বাস্থ্যবান জগতে পরিণত হবে। আর এ প্রজন্মকে উপযুক্ত দিশা দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযুক্ত ভূমিকা নিতে হবে।full-width