আমাদের হৃদয়ের ধারণ ক্ষমতা কতটুকু? কতটা কষ্ট হৃদয়ে রেখে দেয়া যায় অনায়াসেই? কেন ছোট্ট এই হৃদয়ে অসীম দুঃখের সাগর বারেবারে ঢেউ তোলে? সত্যিটা হলো এই, আমাদের কল্পনায় আমরা সমস্ত পৃথিবীর যতটুকু দেখতে পাই, আমাদের হৃদয়ে ঠিক ততোটা কষ্ট ধারণ করতে পারি। আমাদের ভাবনার ব্যাপ্তি যতদূর, আমাদের কষ্টের সীমাও ততদূর বিস্তৃত। আমরা যতটুকু ভালোবাসতে পারি, ততটুকু কষ্ট ধারণ করতে পারি। আমরা যখন কাউকে বা কোনো কিছুকে ভালোবাসি, তখন আমরা সে ব্যক্তি বস্তুর বা ধারণার অস্তিত্ব নিজের হৃদয়ে ধারণ করি পরম মমতায়, আন্তরিকতায়, ভালোবাসায়। ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ে আলো জ্বালায়, আমরা সে আলোয় নিজেদের দেখি। যদি কখনো এমন হয়, সে আলোতে আর আমরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছি না, সব কিছুকে এক আঁধার এসে ছেয়ে ফেলেছে, তখন সে আঁধারকে আমরা দুঃখ বলে থাকি। আমাদের হৃদয় এমনভাবে তৈরি যে, সেখানে যতটুকু আলো রাখা যায় ঠিক ততোটাই আঁধার রাখা যায়। হৃদয় যখন আঁধারে ছেয়ে যায়, তখন অবচেতনভাবেই হৃদয় আলোর খোঁজ করতে থাকে। যে হৃদয়ে ভালোবাসা নেই, সে হৃদয়ে কখনো আলো আসে না। তাই, আলোয় বাঁচতে হলে প্রথমেই হৃদয়কে ভালোবাসার উপযুক্ত করে তৈরি করতে হয়। আমাদের কাজ, আমাদের ভাবনা, অর্জন, জ্ঞান, সব কিছু মিলে আমাদের হৃদয়কে ভালোবাসার আধার করে গড়ে তোলে। হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। সে আকাশটা ছুঁয়ে ফেলতে পারলে মনের মধ্যে যে আনন্দ বয়ে যায়, সে আনন্দের উৎপত্তি হয় অসীম বেদনা থেকে। হৃদয়ে সুখের শস্যের চাষ হয় দুঃখ দিয়ে। নিরন্তর সুখ প্রাপ্তি কিংবা নিরন্তর দুঃখ প্রাপ্তি, এর কোনোটাই এ পৃথিবীতে হয় না। সুখভোগের সীমা বৃদ্ধি করার একমাত্র নিয়মই হচ্ছে, নিজের সাধ্যের মধ্যে সুখকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। দুঃখভোগের সীমা হ্রাস করার একমাত্র নিয়মই হচ্ছে, দুঃখকে আপন করে নিয়ে নিজেকে ক্রমাগত আঘাত আর দহন করার মাধ্যমে দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় সন্ধান করা এবং সে উপায় অনুযায়ী কাজ করা। পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে নিজেকে সুন্দর করতে হয়। সুন্দর মানে কি? সবচাইতে সুন্দর মানুষ কাদেরকে বলি? যাদের দেখলে যাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে আমাদের দৃষ্টি আটকে যায়? না। সবচাইতে সুন্দর তারাই, যাদের সাথে কথা বললে, যাদের সংস্পর্শে থাকলে তাদের হৃদয়ের ঐশ্বর্য আমাদের তীব্রভাবে স্পর্শ করে। যাদের সাহচর্য আমাদের স্বস্তি দেয়, নির্ভরতা দেয়, আনন্দ দেয়, তারাই সুন্দর। সুন্দর তারাই, যাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার পরও কথা ফুরিয়ে যায় না, মনে হতে থাকে, আরো কয়েক জন্ম তাদের সাথে গল্প করা যাবে, তাদের কাছাকাছি থাকা যাবে। কেউ একজন ইমাম জাফর আল সাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "স্রষ্টা কি চাইলে পৃথিবীর আকৃতি না কমিয়ে এবং ডিমের আকৃতি না বাড়িয়ে পুরো পৃথিবীকে একটা ডিমের ভেতরে রেখে দিতে পারবেন?" তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, "আপনি আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন তো! কি দেখছেন?" উত্তর এলো, "আকাশ, পাহাড়পর্বত, গাছপালা, অরণ্য।" "আপনার যেমনি করে আপনার ওই ছোট্ট চোখের মণিতে এতো বিশাল-বিশাল জিনিস রাখতে পারছেন, তেমনি করেই স্রষ্টা এই বিশাল পৃথিবীর পুরোটাকেই একটা ছোট্ট ডিমের ভেতরে রেখে দিতে পারবেন।" হৃদয়ের বিশালত্ব ও ক্ষুদ্রত্ব, দুইই আমাদের কল্পনাতীত। হৃদয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য দুটো জিনিস প্রয়োজন- ধৈর্য আর ত্যাগ। আসুক কষ্ট, আসুক দৈন্য, আসুক নৈরাশ্য, আসুক বর্বরতা, আসুক অবিচার, আসুক আঘাত। এর সবকিছুকেই ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের হৃদয়ের রয়েছে। আমরা যেমন হতে চাই, আমরা যেমন হয়ে থাকতে চাই, সেটার প্রতি ভালোবাসাকে জাগিয়ে তুলতে হবে ধৈর্য আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে। তবেই পরিস্থিতির প্রচণ্ডতা আমাদের আর বিহ্বল করে দেবে না। বাইরের পৃথিবীর দিকে চোখ রাখলে নিজেকে মনে হয় এক অসীম মহাসমুদ্রের একটা ফোঁটার চাইতেও নগণ্য। আর দুচোখ বন্ধ করে নিজের ভেতরের পৃথিবীটাকে দেখলে এই বোধ জেগে ওঠে যেন পুরো পৃথিবীই আমার হৃদয়ের মহাসমুদ্র হতে ছোট্ট একটা সুন্দর বুদ্বুদের মতো করে ধীরে-ধীরে জন্ম নিচ্ছে, যে পৃথিবীর বিকাশের সকল নিয়ন্ত্রণই পুরোপুরি আমার হাতে। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই স্রষ্টার অধিষ্ঠান। বাহ্যিক পৃথিবীর মায়া, মোহ, ভ্রান্তি যখন আমাদের অন্ধ করে রাখে, তখন আমরা আর হৃদয়ের মহাসমুদ্রে ভাসতে পারি না। ভালোবাসা, শান্তি, আশীর্বাদ, সুখ, স্বস্তি আর ক্ষমতার সেই অফুরন্ত উৎস থেকে অন্ধত্ব আর অজ্ঞতা আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে। আমাদের আত্মা যখন আমাদের চৈতন্যের সাথে যুক্ত হয়, তখন আমাদের ভেতরে ও বাইরে মিরাকল ঘটতে থাকে, অন্তরের সাথে বাহিরের সংযোগ আমাদের আনন্দ আর প্রশান্তিতে উদ্বেল করে দেয়।
Tags
জীবন