স্বভাব দোষ

প্রতিনিয়ত চারপাশের অনেক সামাজিক অসঙ্গতি আমাদের চোখে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কর্মক্ষেত্রে রওনা হয়েছেন, হটাৎ কানে ভেসে এলো কুৎসিত কিছু গালিগালাজ। সভ্য নামিদামি পোশাক পরিহিত কোন ব্যক্তি, একজন রিকশাচালককে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে, কম ভাড়া দিয়ে চলে যাচ্ছেন। লোকটা একটু দূরে সরে যেতেই অপারগ রিকশাচালক সেই লোকটির মা-বাবা নিয়ে আরো কিছু কুৎসিত বাক্য আওড়ালো, যা ভেসে এলো আবারো আপনার কানে। অথবা অনেকক্ষণ ধরে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে আছে সব গাড়িগুলো। দুইটা গাড়ির মাঝখানে সামান্য কিছুটা জায়গা রয়েছে। পাশ কাটিয়ে মোটরসাইকেলে করে ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে বের হয়ে যেতে চাইছেন আপনি। একটু সামনে এগুতেই পেছনের গাড়িটা অহেতুক সামনে বাড়িয়ে রাখলো। যেতে পারলেন না আপনি। অকারনেই কেউ আপনার সামনে যাওয়ার সুযোগটা আটকে দিল। মনে মনে আফসোস করলেন। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে নিজেকে ধিক্কার করলেন কিছুক্ষণ। কর্মক্ষেত্রে এসে দেখলেন, রিতিমত আপনি চল্লিশ মিনিট দেরি করে ফেলেছেন।
স্বভাব দোষ
আপনার কাজ তদারকি করার দায়িত্ব যেই সিনিয়ার এর ওপর, তিনি যখন আপনার সামনে আসেন তখন তিনি হয়ে যান এক কাঠের পুতুল। বয়সে হয়ত সে আপনার ছোট কিন্তু তাকে সম্বোধন করতে হচ্ছে অত্যন্ত বিগলিত অবস্থায়, নিতান্ত সতর্কতার সাথে। আর আপনাকে সে অবলীলায় ডাকছে, নাম ধরেই। আপনি যখন কোন সামান্য ভুল করে ফেললেন, তখন সেই সিনিয়ার হয়ে যাচ্ছেন খুবই অমার্জিত হৃদয়হীন ব্যক্তি। হয়ত গতরাতে আপনার ছোট্ট মেয়েটার খুব জ্বর ছিল গায়ে, খুব কাঁদছিল মেয়েটি। সারারাত কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছিলেন। সারারাত জাগা একজন শ্রান্ত পিতার পক্ষে অফিসের কাজে সামান্য ভুল হয়ত হতেই পারে, কিন্তু কর্পোরেট এটিচিউট বলে কথা। সেখানে ভুল, কেবলই নিছক ভুল আপনাকে ভুল করার জন্য টাকা দেওয়া হয়না। হয়ত এমন কিছু বাক্য শুনে ফেলেন খুব সহজেই। যখন এইসব পরিস্থিতিতে, সিনিয়রের গালমন্দ শুনে লাঞ্চ টাইমে চুপ করে বসে থাকেন, তখন হয়ত আপনার জুনিয়র কেউ, একটা খুব সাধারণ তথ্য জানতে এসে, আপনার কাছে ঝাড়ি খেয়ে অবাক হয়ে আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাড়ি ফেরার সময়, ভিড় ঠেলে খুব কষ্টে বাসে উঠলেন। কিছুক্ষণ পরপর যাত্রীদের সাথে কন্ডাক্টরের তর্কাতর্কি চলছেই। এ দেশে বাস কন্ডাক্টরদের ওপর সকলের কেমন জানি এক আদিম রাগ। একটু সুযোগ পেলেই ফুঁসে ওঠে সবাই। গালমন্দ শুনতে শুনতে সেদিনের মত বাড়ি ফিরলেন, আপনি বেশ ক্লান্ত। আগামী দিন নতুন সূর্য উঠবে। নিষ্ঠুর শহরে কাটাতে হবে আরো একটা দিন। এমন আরো অনেক অহেতুক নিষ্ঠুরতা প্রতিনিয়ত আমরা সয়ে চলি। একসময় মেনে নেই, এদেশে থাকতে হলে এসব মেনেই চলতে হবে। কিন্তু কেন একজন মানুষ, অন্য একজন অপরিচিত মানুষের সাথে অকারণে নিষ্ঠুরতা করবে? কি লাভ তার? নাহ! লাভ বা ক্ষতি কিছুই নেই এতে। এটা নিছক পরশ্রীকাতরতা হয়ে গেছে আমাদের। খানিকটা স্বভাব বললেও ভুল হবে না। কিন্তু কেন হল আমাদের এই স্বভাব?আমরা যদি একটু গভীরে যাই, তাহলে কিছু আপাত যুক্তি আমাদের সামনে এসে যাবে।

প্রথমত- আমরা আমাদের অগোচরে একটি চক্রের ভেতর ঢুকে পড়েছি, যেখানে সবাই মেনে নিয়েছি, কোন কিছু সহজ নয়। কেউ সহজে কেন কিছু পাবে?আমি তো সহজে পাইনি, অথবা পাচ্ছি না, তবে সে কেন পাবে? ব্যাস! এটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু কেনইবা হল এই দৃষ্টিভঙ্গি? আমাদের এই স্বভাবটির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল আমাদের পরিবার থেকেই।

স্কুলে ভর্তির বয়স হল। আপনার অজান্তেই দুই বছর কমিয়ে একটা মিথ্যে জন্মতারিখ পেয়ে গেলেন। কারন?
দুই বছর আরো বাড়তি চাকরির বয়স পাবেন, তাই। শুরু হল মিথ্যে জন্ম পরিচয় নিয়ে পথ চলা। যে জীবনের শুরু হয় মিথ্যে জন্ম পরিচয় নিয়ে, সে জীবনে আদর্শের স্থান আর কোথায় হতে পারে?

মনে করে দেখুন, যখন আমাদের বয়সের চেয়ে ব্যাগের ওজন ছিল বেশি, তখন থেকেই মা-বাবা বলতেন- অমুকের চেয়ে কম নম্বর কেন পেলি? তমুক এটা পারে, তুই কেন পারিস নি? মনে মনে সেই অমুক আর তমুকেরা হয়ে গেল আপনার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্যাস, ঢুকে গেল একটা প্রতিবিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার বীজ। সন্ধ্যে বেলায়, তাল পাখার ডান্ডি হাতে, দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মা বলছেন- ‘‘খবর্দার- পরীক্ষার হলে খাতা ঢেকে ঢেকে লিখবি, কেউ ডাকলে তাকাবি না।’’ ব্যাস, ঢুকে গেল আত্মকেন্দ্রিকতার বীজ!

এভাবেই ক্রমে ক্রমে, এটা একদিনের ফসল নয়। এমনি করে আরো অনেক সঙ্কীর্ণতা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। একটা সুখী মানুষ, কখনো সমাজে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে না। আর সুখের শুরু, পরিবার থেকে। কিছু দিনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা আমরা প্রমাণ হিসেবে মিলাতে পারি। পিতামাতাকে হত্যা করা ঐশী, ধর্ষক সাফাত, নাইম বা আরও যারা আছে, এদের কেউই সুখী পরিবারের সদস্য নয়। বিলাসিতা, প্রাচুর্যতা বাহ্যিকভাবে মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বিমোহিত করে, কিন্তু ভেতরের মানুষটা বিষণ্ণতা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে যায় একসময়। জড়িয়ে যায় অন্ধকার জগতে। অসৎ উপার্জনে স্ত্রী-সন্তানের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে চাইছেন? নিজেকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করুণ, ভেতরের শান্তিটা আছে তো? যে পরিবার প্রকৃত অর্থে সুখী, সেই পরিবারের প্রতিটি মানুষ সহজ। তারা পৃথিবীকে সহজ ভাবে গ্রহন করতে পারে। তারা যে কোন মানুষের অপারগতাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। মানুষের প্রতি হয় কোমল ও সহানুভূতিশীল। কারো সাথে মতপার্থক্য হলে সেটাকে মতবিরোধ হিসেবে পুষে রাখেনা। তারা হয় প্রকৃত অর্থে ধৈর্যশীল মানুষ। যদি অন্যের সফলতায় আমি ঈর্ষান্বিত হই, যদি কারো সমস্যা বা কষ্ট আমাকে আনন্দ দেয়, তবে সচেতন হতে হবে। নিজেকে সংশোধনের কাজ শুরু করতে হবে। আর আমাদের কাজ শুরু করতে হবে ঘর থেকে। নিজের ঘরকে সুন্দর করুণ, পৃথিবী সুন্দর হয়ে যাবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form