বদনা নামটি নগন্য হলেও দিনে বেশ কয়েকবার আমাদের সবার বদনার প্রয়োজন হয়। বদনা আবিস্কার না হলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ থেকে যেত, মানবসভ্যতা বিকশিত হতনা। তাই বদনাকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। বিশেষ করে সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও খোদ ইউরোপের কিছু কিছু দেশে বদনা ছাড়া টয়লেট করার চিন্তাও করা যায়না। টয়লেট কর্ম ছাড়াও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজে লাগে বদনা। পাড়া-গ্রামের ক্ষেত-খামারে পানি দেয়ার কাজটি বদনা দিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায়। আবার অনেক সময় গোসলের কাজেও বদনা প্রয়োজন হয়। শৈশবে বিলে মাছ ধরার সময় বদনায় পানি দিয়ে জিয়ল মাছ রেখে পুকুরে ছেড়ে দিতাম আমরা। এ ছাড়াও বন্দর নগরী চট্রগ্রামে বদনা শাহের মাজার রয়েছে। এরকম আরো হাজারো কাজের কাজী এই বদনা!
বদনা উপকারী জিনিস হলেও দুর্গতির ইতিহাসও আছে। আগে অবস্হাপন্ন গৃহস্তদের কাছে পিতলের বদনা ব্যবহার ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। পিতলের এসব বদনা ছিল অস্বাভাবিক ভারী। গ্রামের বাড়ীতে শৈশবে দেখা একটা ব্যাপার উল্লেখ করছি। বিনা নোটিশে হঠাৎ প্রকৃতির ডাকে দিশেহারা হওয়া এক পথচারী হন্তদন্ত হয়ে আমাদের উঠানে ঢুকে টয়লেট কোথায় জানতে চাইলেন। আমরা ছোটরা টয়লেট দেখিয়ে দিলে সামনে থাকা পিতলের বদনা নিয়ে দৌড়ে টয়লেটে ঢুকল বেচারা। কিন্তু পিতলের ভারী বদনাটি খালি হলেও ওজনে পানি ভর্তি প্লাস্টিক বদনার সমান ছিল। তাই খালি বদনাকে পানি ভর্তি মনে করে টয়লেটে ঢুকে মনের সুখে টয়লেট করার পর খালি বদনার ব্যাপারটা নজরে আসে তার। কিন্তু তখন বেচারা লজ্জায় শেষ। এর দীর্ঘক্ষন পরে আমরা তাকে উদ্ধার করেছিলাম।
বদনা নিয়ে মারাত্নক বিপত্তিতে পড়েছিলেন নতুন এক জামাই শশুর বাড়ীতে এলেই এক দঙ্গল শালা-শালীদের জ্বালায় অস্হির থাকেন বেচারা। একান্নবর্তী পরিবারে নিজ ও চাচাতো-জেঠাতো মিলিয়ে দেড় ডজনখানিক শালা-শালী, এককথায় যন্ত্রনার বাহার। তিন-চার ঘরের তিনিও একমাত্র দুলাভাই, তাই উপদ্রবগুলো হজম করা ছাড়া উপায় ছিলনা। তো একবার শশুরবাড়ীতে চর্ব্য, চোষ্য ও লেহ্য বিভিন্ন আইটেম সহযোগে ভরপেট খেয়ে ওভারলোড হওয়া দুলাভাইয়ের টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল। দুষ্টের হাড্ডি তার এক শ্যালক ছিদ্র হওয়া পুরাতন একটা বদনায় পানি ভর্তি করে দিল। দুলাভাই তা নিয়ে টয়লেটে ঢুকে মনের সুখে, ধীরে-সুস্হে সময় নিয়ে ভারমুক্ত হলেন। ত্যাগেই প্রকৃত শোক, কথাটি বুঝার আগেই কিন্তু ততক্ষনে ছিদ্র দিয়ে বদনার পানি শেষ হয়ে গেল। কাজ শেষে পরিস্কার হতে গিয়ে ব্যাপারটা নজরে এল তার। ঘটনার ভয়াবহতায় বেচারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে অপবিত্র অবস্হায় দীর্ঘক্ষন ধরে কমোডে বসে আছেন। কাউকে ডাকতেও পারছেন না, আবার এত সময় টয়লেটে অবস্হান করাও “ইজ্জতের মামলা”। আবার নতুন শশুরবাড়ী বলে কথা, কেলেংকারীর ভয়। এদিকে টয়লেট করার প্রয়োজন না হলেও বাঁদর টাইপের আরেক শালা বদনা নিয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে, দুলাভাইকে নাজেহাল করার লক্ষ্যে। ভিতরে নতুন জামাইয়ের অবস্হা কেরোসিন। অবশেষে বাড়ীর মুরুব্বীরা ব্যাপারটা টের পেয়ে ফাটাবাঁশ হাতে নিয়ে পিচ্চিগুলোকে ধাওয়া করে জামাইকে উদ্ধার করলেন। তার তখনকার শালাগুলো আজ সবাই দেশে-বিদেশে কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, আর শালীরা সবাই পুরোদস্তুর গৃহিনী। পারিবারিক উৎসব-পার্বনে সবাই একত্রিত হলে এই বদনাকান্ড এখনো নির্মল হাসির খোরাক যোগায়। এই না হলে বদনা বিপত্তি!
বদনা এমনই এক জিনিস। এখনকার জামাইদের আবার এরকম নাজেহাল করার সুযোগ নেই, কারন এখন টয়লেটের ভিতরেই পানির লাইন। আজকাল সব জায়গায় পরিবেশ রক্ষা বড় একটা ফ্যাক্টর। বিভিন্ন ব্যাপারে পরিবেশ বাদীরা সবসময়ই বেশ সেচ্চার। আজকাল প্লাস্টিকের বদনা ব্যবহৃত হচ্ছে। প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব মাটির বদনা ব্যবহার ও প্রচলনের জন্য আন্দোলন করতে পারেন পরিবেশ বাদীরা। গণমানুষের অধিকার রক্ষার নামে ভূঁইফোড় ও প্যাড সর্বস্ব বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্হার বাড়াবাড়ি-ধান্দাবাজি আজকাল চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু প্রত্যেকজনের জন্য মাথাপিছু একটা করে বদনা নিশ্চিত করার জন্য কোন সংস্হা এখনো গঠিত হয়নি। এজন্য আন্তর্জাতিক “বদনাধিকার” সংস্হা গঠন করা যায়!
বদনা দেখতে অপ্রয়োজনীয় হলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অসীম অবদান রাখছে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গার পর কর্মব্যস্ত একটি দিন শুরু হয় বদনা দিয়ে। এ সংশ্লিষ্ট কাজটা আগে সারার পরেই অন্য কিছু। কিন্তু এই বদনা যদি কোন দিন হরতাল-ধর্মঘট জাতীয় কোন কর্মসূচী পালন করে, তবে সেদিনকার পরিস্হিতিটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। কিন্তু নিস্প্রান এ বস্তুটির এত মাথা নেই বলে রক্ষা। আপাতঃদৃষ্টিতে রিহ-নির্জীব হলেও এই বদনা কিন্তু সবসময়ই বিশাল ক্ষমতা রাখে। এর ক্ষমতার কাছে সবাই অসহায়। কেননা আপনি যত বড় ক্ষমতাধর, রাজনীতিক কর্মকর্তা, বেশুমার পয়সা ওয়ালা, পাড়া-মহল্লা কাঁপানো মাস্তান ও ক্যাডার অথবা দাপুটে সাংবাদিকই হোননা কেন, বদনা হাতে টয়লেটে যাওয়ার পরই কিছুক্ষনের জন্য অাপনার সব ক্ষমতা, দাপট ও বাহাদুরি শেষ। কারন বদনার সামনে আপনাকে কাপড় খুলতেই হবে, সেখানে কোন প্রকার ছাড় নেই। বদনার এ ক্ষমতা অস্বীকার করার উপায় নেই, এই সুপার পাওয়ারের সামনে ধনী-গরীব, ছোট-বড়, ক্ষমতাশালী-ক্ষমতাহীন সবাই এক সমান। তাই চোখ মুখ বন্ধ করে বলা যায়, একমাত্র এখানেই প্রকৃত গণতন্ত্র আছে। তাই বদনাই হতে পারে গনতন্ত্রের প্রকৃত রূপ, আইকন অব রিয়েল ডেমক্রেসি। বদনা, সবার জন্য বয়ে আনুক অনাবিল সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি।