আমাদের সমাজ

মানুষ দৈহিক গঠন, চিন্তা, বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে অন্য সব জীবের থেকে আলাদা বলে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। এই আলাদা স্বত্ত্বা তাকে দিয়েছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। মানুষ নিজের চেষ্টায় পরিবার থেকে শুরু সমাজে বসবাস করার সব উপকরণ তৈরি করেছে। নিত্য নতুন আবিস্কার দ্বারা জীবনকে আরো সহজসাধ্য করেছে। নিজের প্রয়োজন অনুসারে নির্মান করছে আইন-কানুন, সমাজ, রাষ্ট্র। মানুষ সমাজে এই আইন কানুন তৈরির পেছনে একটা কারণ ছিল তা হল- মানুষ যাতে তার নির্মিত সমাজের ভেতর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকে, শৃংখলা বজায় থাকে। এই শৃংখলার বিধান অত্যন্ত জটিল। কেননা আদিকালে মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার কোন বিধান ছিল না। মানুষ প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। সমাজে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রনের কলাকৌশল ছিল সহজ সরল। মানুষের জীবন জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রাম থেকেই মানুষ উদ্ভাবনি ক্ষমতা অর্জন করে। কাঁচা মাংস খাওয়া মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে শিখে, তার জীবনের বিশাল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন মানুষের অভ্যাসকে বদলে দেয়। খাদ্যাভাসের পরিবর্তন মানুষ শিখে যায়। এই খাদ্যাভাস মানুষ আর বনের পশু থেকে আলাদা করে দেয়। ইতিহাসের আলোকে মানব বিজ্ঞানীরা মানুষের চিন্তা চেতনা ও মগজ বিকাশের সাথে যে বর্ণনা দেন তার সাথে মানুষের খাদ্যাভাস অনেকটা দায়ি। মানুষের মগজের আকার অনেকটা বড়, অন্যান্য প্রাণী তুলনায় প্রায় নয় গুণ বড়। এই মগজের আকার নাকি চিন্তা চেতনা, বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ দ্রুত কাজে আসে। অন্যান্য প্রাণী নিজেরা দলবদ্ধ জীবন যাপন করার অনেক উদাহরণ আছে সত্য কিন্তু মানুষের দলবদ্ধতার সাথে তার তুলনা হয় না। কেননা মানুষ তার সন্তানকে বক্ষণ করেনা। তাকে মানুষ হিসাবে সমাজে বিকাশ লাভে সহায়তা করে। তাকে শিক্ষা দেয়, সামাজিকায়ন করে। কিন্তু এমন নজির যখন আমরা দেখি সন্তান তার পিতা-মাতাকে হত্যা করছে। কিংবা পিতা-মাতা তার সন্তানকে হত্যা করছে। তাহলে সমাজের উন্নতি, বিকাশ, বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রসরতা আমাদের কি কাজে আসছে? কেন এই মানসিক বৈকল্য? মানুষ যখন মানুষের উপর পাশবিক নির্যাতন করে, তখন সে কি নিজেকে আর মানুষ হিসাবে পরিচয় দেয়ার দাবিদার? নাকি সে নরপশু?। এই নরপশুরা সমাজে বসবাস করলে, বুক চেতিয়ে চলাফরা করলে অন্য সাধারণ নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশুদের মনে কি দাগ পড়ে তা কিভাবে বুঝানো যাবে, আমার কাছে সে ভাষা নেই।

আমাদের জীবনের সময় সীমিত। এই সীমিত সময়ের মাঝে আমাদের অনেক কাজ করতে হয়। সমাজ সংসার ধর্ম-কর্ম সব এই সীমিত সময়ের মাঝেই করতে হয়। কাজেই সুন্দর কাজ আগে করা দরকার। বার বার ভুল করে কোন কাজ করে তা সংশোধন করে করা অনেক কঠিন। অন্যদিকে দাঙ্গা ফ্যাসাদ করে কি লাভ অর্জন করা যাবে জানিনা। জীবনে আগে বাঁচতে হবে। জীবিত থাকলে অনেক ভাল কাজ করার সুযোগ আসবে। জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা জরুরী। জীবন মানেই সুন্দর। সুন্দর জীবনের চিন্তাও সুন্দর হোক। বাঁচা মানে চিন্তা ও মননে সতেজ থাকা। যারা জীবনে মৃত আমি সে দলের বাইরে থাকতে চাই। মানুষ ততক্ষণই জীবিত যতক্ষণ সে সত্য মিথ্যার ব্যবধান করতে পারে। অসত্য কে জীবনের অনুষঙ্গ করা মানে এক ধরনের আত্মহত্যা। আমাদের সমাজে অসত্যকে জীবনের সাথী হিসাবে মেনে নেয়ার সংখ্যাই বেশি। অর্থাৎ আত্মহত্যার পথে চলমান, মৃত জীবনের মানুষের সংখ্যাই বেশি। মিথ্যার জয় জয়কার। কিসের কারনে মানুষ আজ অন্ধ, বধির, বোবা? একজন মানুষ একবারই এই বিশ্বচরাচরের বাসিন্দা হয়। এখানে দ্বিতীয়বার আর আসার কোন সুযোগ নেই। যতদিন জীবন আছে, প্রাণ আছে, আত্মা আছে, বোধ শক্তি চেতনা আছে, সত্যের সাধন করা আবশ্যক। অসত্য জীবন নয়। মানুষ হিসাবে মানবীয় দায় অসীম। পিতার কাছে সন্তানের দায় যেমন অনিবার্য, সমাজ রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের দায় তেমনি। মানুষ যখন অমানুষী আচরণ করে তখন তাকে কি আর মানুষ বলা যাবে? আজকাল এদের সংখ্যাই বাড়ছে। সমাজে এদের কদর বাড়ছে।

মানুষের জন্মের সময় শুধু মাত্র মানবের আকৃতি পায় তখন নিষ্পাপ, অবুঝ শিশু থাকে। তার মন মেজাজ একেবারেই নিষ্পাপ, নিষ্কুলুস। তার চিন্তার বিকাশ ঘটে অতি ধীরেধীরে। তার পরিবার, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সহ চারপাশে যা কিছু আছে তার প্রভাব পড়ে এই শিশুর চিন্তন ক্রিয়ার মাঝে। পরিবার সমাজের যে সকল উপাদান সে প্রত্যক্ষ করে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরণে। চিন্তা শক্তির প্রতিটি উপাদান পরিবেশ থেকে পাওয়া। আমাদের এই সময়ের পরিবেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের যে আচরণ বা প্রকাশ ঘটছে তারই প্রভাবে শিশুরা আচরণ করছে। সমাজ কাঠামোর ভেতরকার সংকট থেকেই জন্ম নেয় অপরাধ। মানুষের অপরাধ প্রবণতা আসে অন্য আরেকজনের অপরাধ করা দেখে। মানুষ যখন দেখে একজন অপরাধ করছে তার বিচার হচ্ছে না, শাস্তি হচ্ছে না। বুক ফুলিয়ে সে হেটে বেড়াচ্ছে, অপরাধীর দাপট আরো বেশি! সমাজের সাধারণ মানুষ নির্যাতনের ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কারণ, সে শান্তি চায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাদের দায়িত্ব তারাই অহরহ আইন ভেঙ্গে চলেছে। আইন নিজের হাতে নিচ্ছে। কারো কোন কিছু বলার নাই। রাষ্ট্র ক্ষমতা যখন যাদের হাতে গেছে বা আছে তারাই সবাই আইনকে তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা তাই করছে। তখন আইনের শাসনের কথা বলে লাভ কি? সর্বক্ষেত্রে, নৈতিক আদর্শিক মানদন্ড হারাচ্ছে আমাদের দেশে। উন্নতি হচ্ছে, রাস্তার বড় হচ্ছে, বড় বড় দালান হচ্ছে, সুন্দর সুন্দর গাড়ি আসছে। কিন্তু সমাজের ভেতরে যে সৌন্দর্য তা হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিকতা বোধের চেতনা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, আইন, কানুন, শ্রদ্ধা ভালবাসা, সন্মান, পরার্থপরতা ইত্যাদি যেন দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

মানুষের মনের একটা খোলা জানালা আছে। এখানে ভাল উকি দেয় তেমনি মন্দও উকি দেয়। ভাল দেখতে পায় আবার মন্দও দেখতে পায়। মন্দ ভালোর উপরে প্রভাব ফেলে। এই প্রভাব আসে অাশেপাশের পরিবেশ, শিক্ষা, মূল্যবোধ, সামাজিক কাঠামো, আমাদের জীবনকে তাড়িত করে। মানুষের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি জয় করা সহজ সাধ্য ব্যাপার নয়। সমাজে যদি ন্যায় বিচার না থাকে শুধু মূল্যবোধ দিয়ে সমাজের মন্দ প্রতিরোধ করা যাবে না। আমাদের সমাজ অনেক অস্তির, এই অস্তির সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়ের প্রতিষ্টা করা আরো কঠিন। মানুষের ভেদাভেদ আছে। সাদা কালোর ব্যবধান আছে। ধনি-গরিবের ব্যবধান আছে। এই ব্যবধানের সাথে আছে সামাজিক দূরত্ব। সব মিলিয়ে আছে সমাজে নানান অস্তিরতা। এর পেছেনে আছে দ্রুত কোন কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে আছে দূষিত রাজনীতি। এই রাজনীতিকে ভর করে আমাদের সমাজে এক ধরনের বানিজ্যিক চক্র গড়ে উঠে। এতে রাজনীতিক, ব্যবসায়িক আমলা সকলে এক কাতারে মিশে যায়। একে অপরের সহায়ক ভূমিকা হিসাবে কাজ করে। কেউ বিপদে পড়লে আরেক জন চলে আসে সহযোগীর ভূমিকায়। নিরাপরাধ মানুষ জেল জুলুমের শিকার হলে রাঘব বোয়ালরা থেকে যায় পর্দার আড়ালে। এর দায় কার? একক কোন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা নেতার দায় নয়। এই দায় আমাদের সকলের। যে যেখানে আছে, তার জায়গায় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলেই এই সমাজ বদলে যাবে।

Admin

Amir hossain is a social article writer. he likes to share knowledge and Interested research content of biodiversity, climate, travel, photography

1 Comments for "আমাদের সমাজ"

Previous Post Next Post

Contact Form