পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। কোরআনের প্রথম যেই শব্দটি মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে, তা হলো (ইক্বরা) পড়। সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে তাঁর বাণী পাঠানোর সময় কেন ‘পড়’ শব্দটি দিয়ে শুরু করলেন, তা আমাদের বোঝা দরকার। নিশ্চয়ই এর মধ্যে শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে।
আল্লাহ শুরু করতে পারতেন তাঁর পরিচয় দিয়ে, যেমন “তিনি এক আল্লাহ, অদ্বিতীয়”। অথবা নামাজ পড়, সিজদা করো এধরনের ধর্মীয় নির্দেশ দিয়ে। কিন্তু তা না করে তিনি শুরু করেছেন ‘পড়’ দিয়ে। আজকে মুসলিম জাতির দুরবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়- একটি মূল কারণ হচ্ছে না পড়া। আমরা বেশিরভাগই ইসলাম শিখি শুনে, পড়ে নয়। লোকমুখে প্রচলিত নানা বিশ্বাস, ধারনা আজকে আমাদের কাছে ইসলাম হয়ে গেছে। অমুকে বলেছে তমুক সুরা লিখে ঝুলিয়ে রাখলে নাকি দুর্ঘটনা হয় না। শুনেছি অমুক সময়ে তমুক নামাজ পড়লে নাকি ব্যবসা ভালো যায়, স্বাস্থ্য ভালো হয়। শুনেছি অমুক মাজারের মাটিতে নাকি বরকত আছে। ওখানে গিয়ে দুআ করলে দুআ কবুল হয়। আমার বাপ-দাদাকে দেখেছি অমুক করতে, নিশ্চয়ই সেটা সঠিক। তারা কি সারাজীবন ভুল করেছেন নাকি? এই হচ্ছে আজকে মুসলিম জাতির একটা বিরাট অংশের মন-মানসিকতা। প্রচলিত ধ্যান-ধারনা বিশ্বাসকে পড়ে যাচাই করে দেখার মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তার বড়ই অভাব।
একজন মুসলিমের প্রথম কাজ হচ্ছে কোরআন পড়া। যেখানে আল্লাহর নিজের কথা লেখা আছে, আল্লাহ কোরআন পাঠিয়েছেন পড়ার জন্য, আলমারির উপরে তুলে রাখার জন্য নয়। অনেকে মনে করেন, কেউ কোরআন নিজে থেকে পড়লে সে ভুল বুঝবে। “কোরআন নিজে না পড়ে বরং অমুক ইমাম, ওস্তাদ যা বলেন, তাই শোনো।” এই ধারনার ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। গত হাজার বছরে বেশ কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ইমাম, ওস্তাদ, শায়খ নিজেদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য ইসলামের বিকৃত বাণী প্রচার করে বহু মুসলিমকে বিভ্রান্ত করে গেছে। মুসলিমরা আল্লাহর বাণী নিজেরা না পড়ে, এই সব নেতাদের কথাকে চ্যালেঞ্জ না করে, অন্ধভাবে মেনে নিয়ে, ছোট-বড় শিরকের মতো গুনাহ থেকে শুরু করে অন্য মুসলিমদের হত্যা করার মতো জঘন্য কাজও করে গেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। এই ভয়ংকর সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে মুসলিমরা নিজেরা কুর‘আন পড়ে ইসলাম শেখে না, তারা মানুষের মুখের কথা শুনে শেখে, তারপর যা ভালো লাগে তাই করে।
শুধু মুসলিমরাই নয়, ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরাও নিজেরা তাওরাত, ইঞ্জিল না পড়ে বরং তাদের ধর্মীয় পুরোহিতরা যা বলত তাই মেনে নিত। এই সুযোগে সেই ধর্মের বাহকেরা নিজেদের ইচ্ছেমত তাদের ধর্মকে বিকৃত করে গেছে। তারা এমন সব শিক্ষা দিয়ে গেছে, যা তাদের ধর্ম গ্রন্থগুলোতেই লেখা নেই। তারা এই কাজ করতে পেরেছে, কারণ আমজনতা ধর্মীয় গ্রন্থগুলো নিজেরা পড়ত না, বরং তাদের পড়াকে ভয় দেখিয়ে নিরুৎসাহিত করা হতো। সপ্তাহে একদিন গির্জায়, সিনাগগে গিয়ে যা শুনে আসতো, তাই বিশ্বাস করতো। আর এভাবেই তারা ইতিহাসের বৃহত্তম মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়েছে।
অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকা একটি জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তার মধ্যে প্রথম যে পরিবর্তন আনা দরকার, তা হচ্ছে ‘পড়া’। সেই জাতির মানুষগুলোর মধ্যে যদি পড়ার অভ্যাস প্রচলন করা যায়, তাদেরকে যদি ইসলামের জ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, তাহলে সেই জাতি উন্নতি করতে বাধ্য। আমরা যদি আজকে পিছিয়ে থাকা মুসলিম জাতিগুলো দিকে তাকাই, একটি ব্যাপার আমরা লক্ষ্য করবো- সেই জাতির মুসলিমরা পড়ে না, বরং তারা মানুষের কথা শোনে, তারপর যা করতে তাদের ভালো লাগে, সেটাই করে।