“ওলি আল্লাহর নেক দৃষ্টিতে বিদ্যুৎতের ন্যায়, মূহুর্তে আপনার মকছুদ পূর্ণ করিতে পারেন”
হুজুরের এমন মন ভোলানো বয়ানে আচ্ছন্ন হয়ে আমরা নিজেদের অস্তিত্ব, কর্মজ্ঞান ভুলে নিমগ্ন হয়ে চলে যাই ভ্রান্ত পথে। আমাদের সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে উদ্দেশ্যহীন অদৃশ্য গন্তব্যের যাত্রা। আমরা তখনও জানি না কি আমাদের ধর্ম, কি আমাদের কর্ম? কোথায় আমাদের গন্থব্য, কোথায় আমাদের নোঙর? পাল তোলা নৌকার মতো পৃথিবী নামক অথৈ সাগরে, আমাদের জীবন নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছি। পালে বাতাস দোলা দিয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক নিয়ে যাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অতঃপর সেই প্রজন্ম চিন্তায় যখন নৈরাশ্য আর ধ্বংসের ঘূণ বাসা বাধে, তখন আমরা হয়তো জাগি, হয়তো জাগিনা, তখন এর কোনটাই আমাদের কাজে আসেনা।
গ্রামের এক মাজারে প্রতি বৃহস্পতিবারে বসে হুজুরের বয়ানের আসর। পরকাল প্রত্যাশী ধর্মভীরু মানুষেরা এই বিশেষ দিনটিতে মাজারে আসে হুজুরের বয়ান শুনতে। জাগতিক সব প্রয়োজন ভুলে নিমগ্ন হয় বয়ানে, যেন এই বয়ানই তাদের পরকালে পারের একমাত্র ভরসা। রাতভর নিমগ্ন ঋষির মতো এরা বয়ান শুনে আর হুজুরের কৃপা কামনা করে। আল্লাহু, আল্লাহু শব্দে ভারী হয়ে উঠে মাজারের চারপাশ। সে জিকিরের শব্দ বাতাস ভেদ করে। গ্রামের মা-ঝিয়েরা আপসোস ভরা চোখে মাজারের মিট-মিট আলো দেখে আর তাদের চোখে-মুখে পুরুষ হতে না পারার হতাশা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের কেউ কেউ আবার উদ্বিগ্ন হয়ে বাড়ীর কর্তার জন্য বসে থাকে। কিন্তু ধ্যানমগ্ন ঐসব মানুষগুলো তখন ভূলে যায় তাদের জীবন সংসার। তাদের শুধু ধ্যান আর ধ্যান। বাকি ছয়টি দিনের ভন্ডামী, প্রতারণা আর নোংরামীর সনদ তারা এই রাতেই নিয়ে আসে। যারা সপ্তাহভর কাজকর্মে নমগ্ন থাকে, তারা এই একটি রাত গুছিয়ে রাখে পাপ মুচনের প্রত্যাশায়। হুজুরের বয়ানের মর্ম তারা বোঝতে পারে বলে মনে হয়না, তবুও হুজুরের লম্বা-সফেদ দাড়ী তাদের অন্যরকম আকৃষ্ট করে। কেউ কেউ ওই দাড়ীতে নুরের ঝিলিক দেখতে পায়। কেউ কেউ বয়ান একটু একটু বুঝে, কেউ কেউ কিছুই না বোঝে শুধু মাথা দোলায়। এদের মনে কখনও প্রশ্ন জাগেনা বেঁচে থাকা ছাড়া কি মানুষের অন্য কোন কাজ নেই? শুধুই কি এই ধরণের এবাদতের জন্য মানুষের সৃষ্টি?
প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারের চারপাশ ভাল করে পরিস্কার করা হয়। গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ আসে হুজুরের বয়ান শুনতে। হুজুরও তার রাশভাড়ি কন্ঠে আচ্ছন্ন করে রাখেন মাজারের আগন্তুকদের। আতরমাখা এইসব মানুষগুলো নির্দিধায়, গিলতে থাকে বয়ান। কিছুক্ষণ পরপর সমস্বরে জিকির পড়ে- আল্লাহু, আল্লাহু। হুজুর সন্তুষ্টচিত্তে এদের দেখেন, তিনি কল্পনা করেন মাজারের লোক বাড়ছে, বাড়ছে মাজারের নাজরানা। দূর দুরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ আসছে, তিনি তার বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন আর সবাই মন্থমুগ্ধের মতো তা শুনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর-পর্ব। হুজুরের মুরিদরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা হুজুরের দরবারে পেশ করে, হুজুর তার যথাযথ উত্তর আর সমাধান দিতে থাকেন। সবাই সন্তুষ্টচিত্তে হুজুরের কথা মেনে নিয়ে হুজুরকে সালাম করে জিকিরে মেতে উঠে। বাহিরে খাবারের আয়োজন চলে, রাত বাড়ার সাথে সাথে দরবারের লোক কমতে থাকে। সবাই যার যার বাড়ীর পথে রওয়ানা করে, কেউ কেউ আবার দরবারেই রাত্রি যাপন করে। হুজুরের দোয়া প্রার্থীরা হুজুরের জন্য নাজরানা রেখে যান, হুজুর তাদের দু-হাত ভরে ইহকাল আর পরকালিন শান্তি কামনা করেন।
আবেদ মিয়ার সবার মতো হুজুরের দরবারের প্রতি প্রচন্ড টান। প্রতি বৃহস্পতিবার রাত সে হুজুরের দরবারে কাটায়। গ্রামের এক পাশে পৈত্রিক ভিটায় তার পুরনো টিনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়ার ঘরে সে তার বউ আর তার আট বছরের মেয়ের বসবাস। প্রতি বৃহস্পতিবার সে হুজুরের দরবারে একটা ছেলের জন্য আরতি করে আর একটা আরতি অবশ্য তার আছে যদিও সেটা সে প্রকাশ করেনা। তার বিশ্বাস হুজুরের দরবারের উছিলায় সে কোন অলৌকিক সম্পদের মালিক হয়ে যেতে পারে। তবে আজ এতো বছর ধরে না পেলেও সে হাল ছাড়ে না। কারণ হুজুরের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস তার মনবাসনা পূরন না হওয়ার জন্য বরং সে নিজেকেই দায়ী করে। সে ভেবে নেয় নিশ্চয়ই তার কোন অজানা পাপ আছে, কোন ভূল আছে। তবে সে বিশ্বাস করে হুজুরের দোয়া থাকলে একদিন তার বাসনা পূরন হবেই! সে বিশ্বাস করে হুজুরের দারবার থেকে কেউ খালি হাতে ফেরে না। তাই সবার মতো প্রতি বৃহস্পতিবারে চলে আসে হুজুরের দর্শণ লাভের জন্য। আল্লাহু, আল্লাহু জিকিরে ভারী করে তুলে মাজারের পরিবেশ। হুজুর এসে তার মাথায় হাত রাখেন, আনন্দে সে কেঁদে ফেলে হুজুরের কৃপা হয়েছে এই ভেবে। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়, তার জিকিরের গতি বেড়ে যায়। ওইদিন অনেক রাত করে সে বাড়ি ফেরে। তার স্ত্রী আর মেয়ে তখন গভীর ঘুমে অচেতন, সেও তাদের পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তার চোখে-মুখে রাজ্যের তৃপ্তি, সে তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। সে মনে মনে ভাবে আজ তার মাথায় হুজুরের হাতের স্পর্শ পরেছে। আজ বৃথা যেতে পারে না, ছেলে তার চাই। সে তার স্ত্রী দিকে ফেরায় আকাশের অষ্টাদশী চাঁদের আলো তখন মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে।
কয়েকদিন হলো আবেদ মিয়ার মনটা ভালো নেই। কারও বাড়িতে কোন কাজ নেই আর কাজ নেইতো ভাতও নেই। দু-বেলা ঠিকমতো খাবারও জোগার করতে পারছে না সে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। সিদ্ধ চাল আর সিদ্ধ বেগুন ভর্তা দিয়ে চলছে কয়েক দিন। অাট বছরের মেয়েটি ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করে আবেদ মিয়ার সেদিকে কোন খেয়াল নেই, যতো ব্যস্ততা সবই যেন তার স্ত্রীর। সে তার স্ত্রীর তলপেট ভালো করে পরখ করে, কিন্তু কোন পরিবর্তন তার চোখে পড়েনা। তার মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে যায়। সে একটি নাসির বিড়ি টানতে টানতে হাটের দিকে রওয়ানা দেয়। অনেক রাত করে সে বাড়ী ফেরে, খালি হাতেই। তার স্ত্রী তাকে কিছুই বলার সাহস পায়না। নিয়তির কাছে সবাই হারে, কিন্তু সে করেছে আত্মসমর্পণ। আবেদ মিয়া রাতে ঘুমানোর সময় তার স্ত্রীকে জানায়, সে চিন্তা করছে আগামি পুরো-সপ্তাহ সে হুুজুরের দরবারে কাটাবে। প্রার্থনা করবে, হুজুরের কৃপা কামনা করবে। আবেদ মিয়ার স্ত্রী কিছুই বলেনা শুধু নিশ্চুপ হয়ে শুনে যায়।
পরের বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবেদ মিয়া দরবারে যায়, অন্যদিনের মতো বয়ান শুনে, জিকির পড়ে, হুজুরের সেবা করে। তবে সে রাতে সে আর বাড়ি ফেরেনা। পরেরদিন দুপুরে হুজুরের পা পরিষ্কার করার সময় সে হুজুরের কাছে তার মনের বাসনা ব্যক্ত করে। একটি ছেলের জন্য তার মনের হাহাকার, সে হুজুরের কাছে পেশ করে। হুজুর তাকে আশ্বস্ত করে বলেন তিনি দোয়া করে দিবেন, কাজ হয়ে যাবে। আবেদ মিয়া খুশি হয়ে আরো যত্ন করে হুজুরের পা পরিষ্কার করে দেয়। সে হুজুরের উচ্ছিষ্ট খাবার খায়। সে দিব্যি ভূলে যায় তার স্ত্রী ও মেয়ের কথা, তার চিন্তায় শুধু অলৌকিক কিছু নেশার আনন্দে হুজুরের দোয়া কামনা। সে হুজুরের সেবা করে যায় ভাগ্য উন্নয়নের নেশায়। কিন্তু সে জানতেও পারেনা যে, তার অগোচরেই তারই পদতলে পিষ্ট হয় তার প্রজন্ম। শুধু বেগুন সিদ্ধ আর সিদ্ধ ভাত খেয়ে আবেদ মিয়ার মেয়ের পেটে ব্যাথা ধরে। প্রথম দিকে আবেদের স্ত্রী গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু দিনেদিনে ব্যাথা বেড়েই চলে। এদিকে আবার আবেদ মিয়া এক সপ্তাহের জন্য হুজুরের দরবারে, তাকে ডাকাও যাবেনা। দিনের বেলায় গরম তেল মালিশ করে ব্যথা কিছু কমানো যায়, কিন্তু রাতে তা অসয্য আকার ধারন করে। আবেদের মেয়েটি ব্যথায় ডুকরে ওঠে, কিন্তু কিছুই বলতে পারেনা। একটু একটু শব্দ করে, কাদতেও পারে না, মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়ে। আর আবেদের স্ত্রী কিছুই বুজে উঠতে পারেনা কি করবে। আবেদ মিয়ার কাছে দুইবার লোক পাঠিয়ে খবর দেয়া হয়েছে কিন্তু সে বলেছে- সে দরবার ছেড়ে এখন আসতে পারবেনা।
আজ বৃহস্পতিবার, দরবারের তফসিলের দিন। আজ আবার মাজারে লোক সমাগম হবে হুজুরের রয়ান শুনার জন্য। যথারীতি হুজুরের বয়ান শুরু হয় আল্লাহু, আল্লাহু জিকিরে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। গ্রামের এক প্রতিবেশী আবেদ মিয়াকে খবর দেয়, তার মেয়ের অবস্থা ভিষণ খারাপ, সে তেমন গুরুত্ব দেয় না। হুজুরের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, সে আবার নিমগ্ন হয়ে যায়। হুজুরের উপর মেয়ের ভার ছেড়ে দিয়ে যেন সে বাঁচে! হুজুর আশ্বাস দেন কিচ্ছু হবেনা। এক গ্লাস পানিতে ফু দিয়ে বলেন- পানি পড়া খাইয়ে দিলে ইনশাল্লাহ, ভাল হয়ে যাবে। পানি পড়া খাওয়ার পরেও আবেদের মেয়ের ব্যথা কমেনি। ব্যথা বাড়তেই থাকে, মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে সে ব্যাথায় চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকারে তার মা কাঁদতে চায় কিন্তু পারেনা। সে দেখতে পায় মাজারে মিট-মিট করে আলো জ্বলছে। সে আলোয় আবেদ মিয়া আল্লাহু, আল্লাহু বলে সর্বশক্তি দিয়ে জিকির পড়ে, যেন আল্লাহকে সে আজ মাটিতে নামিয়ে আনবেই। কিন্তু সে তখনও বুঝতে পারে না যে, ব্যথ্যাতুর এক নিষ্পাপ মেয়ের কষ্টের চিৎকার। এক অসহায় মায়ের আর্তনাত উপেক্ষা করে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিতে পারেন না। এই মেয়েকে ব্যথ্যা থেকে মুক্তি না দিয়ে তিনি তার মুখোমুখি হতে পারেন না।