বিশ্বাস তুমি আজও আসলে না !!

যেকোন সম্পর্কের সর্বপ্রথম ভিত্তিটাই হল বিশ্বাস। সম্পর্ক মধুর হয়ে ওঠে যদি সেই সম্পর্কে বিশ্বাসের জায়গাটা ঠিক থাকে। সম্পর্কে যদি বিশ্বাস না থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। তাই ভালোবাসার পাশাপাশি সম্পর্কে বিশ্বাসও ধরে রাখাও অনেক বেশি প্রয়োজন। বিশ্বাস আর ভালোবাসার সমন্বয়ে মানুষের জীবন। এ দু’টির মধ্য হতে একটিতেও যদি ঘুণে ধরে তাহলে সেটা কোন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হতে পারে না। বিশ্বাসের কয়েকটা স্তর রয়েছে। নিজের প্রতি বিশ্বাস, অপরের প্রতি বিশ্বাস। হিসেব করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে সবচেয়ে দামী বস্তুটার নাম হচ্ছে “বিশ্বাস”। এই বস্তুতা না হলে পৃথিবীর সব কিছুই যেন মূল্যহীন। জীবনের প্রথম চোখটা মেলে যখন মা’কে দেখেছিলাম তখন জানতাম না তিনিই আমার মা। মহান রাব্বুল আলামীন ছোট্ট মনটার ভেতর এমন একটা বিশ্বাসের অঙ্কুর একে দিলেন যে অনায়েসেই মেনে নিলাম তিনিই আমার মা। তাইতো পরম নির্ভরতায় মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতাম। মায়ের কোলটা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিরাপদ স্থান।

প্রথম যেদিন বাবাকে দেখেছিলাম, কেমন ভয়াতুর, প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে চেয়েছিলাম। মা মুচকি হেসে আমার প্রশ্নের আধা জবাব দিয়ে দিলেন। কারণ মায়ের হাসি দেখে ততক্ষনে ভয়টা কেটে গেছিলো আমার। আমিও ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হেসে ফেললাম। এবার মা পরিচয় করিয়ে দিলেন- তিনি তোমার বাবা। এবার বাবার হাসিটাকেও পরিচিত মনে হল আমার কাছে। দুই তিন মাস পর যখন পিটপিট করে ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক তাকাতে শিখলাম, তখন ছোট্ট মনটায় আরেকটা বিশ্বাসের রেখা অঙ্কুরিত হল। সেটা হল এই আমার পৃথিবী। এই বিছানা, এই চাদর। ঠিক উপরের দিকটায় টুকটুকে লাল একটা কাগজেরফুল। তাইতো ঘুম থেকে জেগেই এখন চিৎকার করে কাঁদি না। মাথার উপর ঝুলে থাকা টকটকে লাল ফুলটার দিকে চেয়ে থাকি, আর হাত পা ছুড়াছুড়ি করে আপন মনে খেলি। কিন্তু খিদে পেলে ঠিকই ওয়া ওয়া করে কেঁদে আমার খিদার জানান দেই।জানতাম না কাঁদলে মা খাবার দিবে না। এই হল আমার নিজের উপর বিশ্বাসের প্রাথমিক স্তর। সেই থেকেই শুরু। ধীরে ধীরে আমার বেড়ে ওঠা, হাঁটতে শেখা। নয়তো প্রথম কদমে যখন ধপাস করে পড়ে গিয়েছিলাম, তখন আর উঠে দাঁড়ানো হতো না যদি নিজের উপর আত্মবিশ্বাস না থাকতো। এসবই হল বিশ্বাস আর ভালোবাসার চাদরে মোড়ানো। বিশ্বাস বলতে সাধারণতঃ পারিপার্শ্বিক বস্তুসমূহ ও জগৎ সম্পর্কে ব্যক্তির স্থায়ী প্রত্যক্ষণকৃত ধারণা বা জ্ঞান এবং তার নিশ্চয়তার উপর আস্থা বোঝানো হয়।

প্র‌তিটা মানুষ তার কিছু স্বপ্ন নি‌য়ে বড় হয়। নারী পুরুষ সম্প‌র্কের ক্ষে‌ত্রে একজন মে‌য়ের জীব‌নে প্রথম পুরুষ তার বাবা, এরপর ভাই। বাবার ম‌ধ্যে যে ই‌তিবাচক বিষয়গু‌লোকে সে পর্য‌বেক্ষণ ক‌রে, সে বিষয়গু‌লো‌কে ম‌নের ম‌ধ্যে লালন ক‌রে। তার প্র‌তি বাবার অাদর, যত্ন, ভা‌লোবাসা প্রকা‌শের ধরণগু‌লো তা‌কে অাকৃষ্ট ক‌রে এবং ধী‌রে ধী‌রে অভ্যস্ত হ‌য়ে ও‌ঠে। তারম‌ধ্যে ছোট থে‌কেই বিশ্বাস তৈরী হয় ভা‌লোবাসা, যত্ন কিংবা গুরুত্ব দেয়ার প্রকাশভঙ্গী এমনই হয়। অন্য কোন অপ‌রি‌চিত প্রকাশভঙ্গী‌তে সে তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ ক‌রে না। কখনও কখনও অভাব বোধ ক‌রে। ‌সে তার ভ‌বিষ্যত জীব‌নের পুরুষ মান‌ুষটি‌কে ‌নি‌য়ে যে স্বপ্ন লালন ক‌রে ম‌নের ম‌ধ্যে সেখা‌নে বাবার কাছ থে‌কে পাওয়া প্র‌তিটা ই‌তিবাচক দিক তো কল্পনা ক‌রেই এমন‌কি বাবার কাছ থে‌কে যা যা পায়‌নি, পে‌লে ভা‌লো লাগত সে গু‌লো ও কল্পনা ক‌রে ঐ মানুষ‌টির ম‌ধ্যে।‌ ঠিক একই ভা‌বে একজন ছে‌লের জীব‌নে তার মাই প্রথম নারী। নারী চ‌রিত্র‌কে সে দেখ‌তে শে‌খে তার মা‌য়ের ম‌ধ্যে। মা‌য়ের ই‌তিবাচক দিকগু‌লো সে খুঁজ‌তে ভা‌লোবাসা, যত্ন কিংবা গুরুত্ব প্রকা‌শের ক্ষে‌ত্রে নারীর ম‌ধ্যে। সেও স্বপ্ন দে‌খে তার ম‌তে সমস্ত ই‌তিবাচক প্রকাশ সম্ব‌লিত একজন নারী তার জীব‌নে আসুক। এভা‌বেই নারী পুরুষের ম‌ধ্যে স্ব‌প্নের পুরুষ প্রত্যাশা করার ব্যাপারটা কাজ ক‌রে। ম‌নে ক‌রে যে মানুষ‌টি আমার জীব‌নে আসবে, সে ভা‌লোবাস‌লে আমার এ মান‌সিক চা‌হিদা পূরন কর‌বে না কেন?

বাস্ত‌বিক প‌ক্ষে একজন মানুষের জীব‌নে তার সব চা‌হিদা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। তাই প্র‌তিটা মানু‌ষের নিজস্ব কিছু ইচ্ছা পূর‌নের ঘাট‌তি থে‌কেই যায়, যা ব্য‌ক্তির জীব‌নে স্বাভ‌াবিক থে‌কে গুরুতর হতাশার জন্ম দেয়। সে অবস্থায় অন্য একজ‌নের মান‌সিক চা‌হিদা ‌বোঝা কিংবা তা পূর‌ণের মান‌সিকতার ‌ভিন্নতা দেখা যায় মানু‌ষের ম‌ধ্যে। তা ছাড়া বেশীর ভাগ সময় অামরা যা চাই, যেমন অনুভব ক‌রি তা ঠিকঠাক মত প্রকাশ কর‌তে পা‌রি না। অনুভূ‌তি প্রকা‌শের সামা‌জিক প্রচ‌লিত ধরনকে মাথায় রাখ‌তে গি‌য়ে বেশীরভাগ সময় কেমন অনুভব কর‌ছি তা বুঝ‌তে পা‌রি‌ না। আবার পা‌রিবা‌রিক প্রচলন বা শিক্ষার কার‌নে অনুভূ‌তির উপ‌রে প‌রিবা‌রের পক্ষ থে‌কে কিংবা আমি নি‌জেই হয়ত নি‌ষেধাজ্ঞা দি‌য়ে দেই। যেমন আমার ছোট বেলায় শি‌খে‌ছি ‘‘বড়‌দের সা‌থে রাগ প্রকাশ কর‌তে নেই’’। তার কোন কিছু ম‌নের মত না হওয়ার কার‌নে য‌দি রাগ অনুভূত হ‌লেও যে‌হেতু শি‌খে‌ছি রাগ প্রকাশ করা ঠিক নয়, তাই মন খারা‌পের মাধ্য‌মে তা প্রকাশ করতাম বা কাঁদতাম। বড় হ‌য়েও ক‌রে‌ছি এভা‌বে এক অনুভূ‌তির প্রকাশ অন্যভা‌বে। পরম্পরায় এভা‌বে একজ‌নের কাছ থে‌কে আমরা আর একজন শি‌খি। রাগটা স্বাভা‌বিক অনুভূ‌তি, কোন কার‌নে রাগ হ‌তে পারে তা‌তে দো‌ষের কিছু নেই। আমরা রাগ প্রকা‌শের ক্ষে‌ত্রে স‌চেতন হব, যা‌তে আমি এমন কোন আচরণ না ক‌রি যা‌তে আমার কিংবা অ‌ন্যের ক্ষ‌তি হয় বা প‌রি‌বেশ নষ্ট না হয়। এ স‌চেতন শিক্ষাটা আমরা জেনা‌রেশন থে‌কে জেনা‌রেশন পাই না। রাগ না করার যে মে‌সেজটা পাই সেটা‌কে ফ‌লো ক‌রে নি‌জে‌কে ভা‌লো মানুষ হি‌সে‌বে প্র‌তি‌ষ্ঠিত করার জন্য। নি‌জের স্বাভা‌বিক অনুভূ‌তিকে আমরা অস্বীকার ক‌রি। আর তা‌তে আমা‌দের চিন্তা ও অনুভূ‌তির যে স্বাভ‌া‌বিক প্রবাহ ব্যাহত হয় অর্থাৎ চিন্তা ও অনুভূ‌তির সামঞ্জস্য থা‌কে না। যা মান‌সিক ভা‌বে আমা‌দের দ্বন্দ্ব, ও অ‌স্থিরতায় ফে‌লে দেয়, একজন মানু‌ষের মান‌সিক স্বা‌স্থ্যের জন্য হুম‌কি স্বরূপ, এমন‌কি মারাত্মক ক্ষ‌তি ক‌রে থা‌কে।

এ সমস্যাগু‌লো নি‌জের সা‌থে এবং অ‌ন্যের সা‌থে সম্প‌র্কের ক্ষে‌ত্রে ‌বি‌ভিন্ন ভা‌বে প্রভাব বিস্তার ক‌রে থা‌কে। স্বাভা‌বিক ভা‌বেই আমা‌দের স্বয‌ত্নে তু‌লে রাখা স্বপ্ন পূর‌ণে আমরা স্ব‌প্নের রাজপুত্র বা রাজকন্যার অ‌ন্বেষণ কর‌তে থা‌কি। য‌দিও রাজকন্যা বা রাজপু‌ত্রের ও মানুষ হি‌সে‌বে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যা আমরা আশা ক‌রি না। যে আমার জন্য শতকরা নব্বই ভাগ কর‌ছে, আমরা আশা করি বাকী দশ ভাগ য‌দি ঠিক হ‌য়ে যেত আমার খুব ভা‌লো লাগত। কিন্তু নব্বই ভা‌গের জন্য তা‌কে স্বীকৃ‌তি দি‌তে ভু‌লে যাই কিংবা প্র‌য়োজন বোধ ক‌রি না। এভা‌বেই আস‌লে সম্প‌র্কের মধ্যে এক সময় অভিমান, অ‌ভি‌যোগ, দ্বন্দ্ব হ‌তে শুরু ক‌রে। স‌চেতনভা‌বে দূর করার জন্য পদ‌ক্ষেপ না নি‌লে তা চর‌মে পৌ‌ছে। তখন চেনা মানুষ‌টি‌কে অ‌চেনা ম‌নে হয়। শত দাবী কিংবা কষ্ট প্রকা‌শেও তার মন গ‌লে না, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

একজন প‌রি‌চিত ব্যক্তি বলে‌ছি‌লেন, এমন আচরণ তো শুরু থে‌কেই কর‌েছি, এমন তো কখনও ক‌রে‌নি! আজ হঠাৎ কি হল? আস‌লে উ‌নি যত‌দিন পে‌রে‌ছেন তত‌দিন ন‌ি‌য়ে‌ছেন। ওনার দেয়া‌লে পিঠ ঠে‌কে গে‌ছে, আর নি‌তে পার‌ছেন না। তাই নি‌জের অ‌স্তিত্ব সংকট কাটা‌তে আজ ঘু‌রে দা‌ড়ি‌য়ে‌ছেন। এখান থে‌কেও ফেরা সম্ভব য‌দি যতটা পথ পে‌রি‌য়ে এ‌সে‌ছেন, ততটা পথ আবার এ‌গি‌য়ে যান এবং দুজনই তা চান।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form