আমাদের এলাকায় গ্রাম্য ভাষায় ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’! এমনই এক অপূর্ব কথ্য ব্যঞ্জনায় উচ্চারিত হয়ে থাকে। আর এরই মধ্যে ফুটে উঠেছে আমাদের সমাজের মানুষের মূল্যবোধের চৌকাঠে ঘুনে ধরা দৃশ্যপট। আমরা হারিয়ে ফেলেছি অমূল্য এক সম্পদ, আর সেই সম্পদটা হলো বিশ্বাস। এখন তো স্বামী-স্ত্রীতে বিশ্বাস নাই, পিতা-পুত্রে বিশ্বাস নাই। নাই বন্ধু বন্ধুতে। ডাক্তারের চিকিৎসায় বিশ্বাস নাই, বিশ্বাস নাই বিচারে। বিশ্বাস নাই শিক্ষকের পাঠদানে, বিশ্বাস নাই বাসের ড্রাইভারে। আর রাজনীতিতে তো বিশ্বাস একদম উধাও হয়েছে। আমার এক সুপরিচিত ব্যাক্তি সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বলে- যে দেশে স্কুলগামী বাচ্চাদের হত্যার বিচার পেতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে, আরো শিক্ষার্থীর প্রাণ দিতে হয়, সেখানে ‘বিশ্বাস’ তো আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মতো। আমি ভাবলাম তাহার কথাটা একদম ঠিক। আরেকজন তো আবেগে বলেই বসলো, এক মিনিটের নাই ভরসা, ‘‘হায়রে দম ফুরাইলে শেষ’’। সে আরো বলে- বন্ধু নিশ্বাসেরই তো বিশ্বাস নাই। এটাওতো একদম ঠিক কথা।
একদিন সরাইল বিদ্যুৎ অফিসের কাজ শেষে ফুটপাতের এক চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন মিলে গল্প করতেছিলাম। এরই মাঝে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে দু-একবার সাহায্য চেয়ে বলে- ‘‘আইজকা সকালে কিচ্ছু খাই নাই। কেউ একটা টাহাও দেয় নাই। আমারে একটা রুডি খাওনের টেহা দেন’’। সবাই অন্য এক ভাবনায় নিবিষ্ট হয়ে থাকার অভিনয় করে নির্বিকার বসে থাকে। কিছু না পেয়ে ভিক্ষুক আমার পাশে বসে পড়লো। আমি অনেকটা কৌতূহলী হয়ে তাহার দিকে তাকিয়ে আছি। সে তার কাঁধের ঝোলাটা খুলে বেশ কিছু টাকা বের করে গুণতে থাকে। আমিও তাহার হাতের আঙ্গুল চালনার সাথে টাকাগুলো গুণেছি, সব মিলিয়ে ১শ’ ৩৭ টাকা। আমি বললাম- এগুলো কি? উত্তরে সে বলে- ‘‘আইজকা সাইদটা ভালো হইছে’’। আমি জিজ্ঞেস করি- ‘‘সকালে কিছু খেয়েছেন?’’ উত্তরে সে মাথা কাত করে বলে- ‘‘পেট ভইরা খাইয়া নামছি। আবার বিকাল বাজারে গরুর মাংস দিয়া খামু।’’ তার সৌজন্যতাবোধ আছে। আমাকে প্রশ্ন করে- ‘‘আপনে নাস্তা করেছেন?’’ আমি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলি- ‘‘টাকাগুলো সব আজকে সকালের?’’ সেও আমার প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর দিল না। কেবল একটু মুচকি হেঁসে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলে- ‘‘হাছা কথার ভাত নাই।’’ ভিক্ষুক চলে গেল, আমার কাছে রেখে গেল এক অমূল্য কথন- ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’।
এইতো কয়েক মাস আগে ব্যাক্তিগত কাজে দেওড়া মিতালি ক্লাবের একটি চায়ের দোকানে। সেখানে রাজনীতি, সম্প্রীতি, সংস্কৃতি, বিরোধ আর অবিশ্বাসের লাগামহীন কথার জোয়ার ছোটে। নামি দামী মূর্খরা সেখানে জ্ঞান বিতরন করেন। দেখে মনে হয় কতই না বিজ্ঞ অথচ তারা একেবারেই গন্ডমূর্খ। এক দোকানে পত্রিকার পাতায় দেখি নির্বাচনী খবর। জানতে পারি নেতা-নেত্রীরা সফরে আসেন, এলাকায় গণসংযোগ করেন। কত কথা আর আশ্বাসের প্রশ্বাস ছাড়েন। একটাই উদ্দেশ্য মানুষের বিশ্বাস ফিরে পেতে চায়। রাজনীতিতে কে আপন? এমন প্রশ্নই ঘুরে ফিরে মানুষের মাথায় জন্ম নেয়। কে সত্যি বলছে? নাকি ঐ ভিক্ষুকের মতোই, এলাকার মানুষদের তারা কেবলই ভোটার মনে করেন। তাদের কাছে ছুটে যায়। সত্যটা আড়াল করে মিথ্যে আশ্বাসের প্রলোভনের বিনিময়ে কেবল একটি ভোট ভিক্ষা চায়! হয়তো সেও ভিক্ষুকের সেই অমূল্য কথন জানে- ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’।
কয়েক বছর ধরে ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’ এমন অমূল্য কথনটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ভাবলাম- এবার আমি নিজেই এর সত্যতা যাচাই করে দেখবো। আসলেই কি আমাদের সমাজ থেকে সত্য কথার দাম চলে গেছে? আমি তা দেখতে চাই? আমি ঠিক করলাম এবার আমি ঐ ভিক্ষুক কিংবা রাজনীতিকদের মতো মিথ্যা বলে নয়, সত্যটা বলে দেখবো আসলে কি ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’। এক আত্বীয়ের কাছে সত্য সমস্যা জানিয়ে বিশ হাজার টাকা চাইতেই, নানান অসুবিধার কথা জানালো ও সুকৌশলে বিষয়টা পাশ কেটে গেলো। সেটা ছিল আমার কাছে একটা নাটকীয় ব্যঞ্জনাময় অনুভূতি। মানুষ তো মিথ্যে বলে কতো কিছুই করে। কাজের নামে মিথ্যে বলে সরকারের তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা এনে আত্মসাৎ করে। মিথ্যে দলিল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা চুরি করে নেয়। গ্রাম-শহর রক্ষার নামে বাঁধের কাজে রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার ব্লক ফেলে সকালে জানায় সবটাই নাকি শ্রুতের টানে ভেসে গেছে। ভূমিহীনদের আশ্রায়ণ প্রকল্পের জায়গা বেনামে বরাদ্দ নেয়। নদী গতিপথের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ টন বালু লুটে নেয়। রাস্তার দুধারে শতবর্ষী গাছ নিধন করে নেয় অনায়াসে মিথ্যে বলে। তাহলে কি ঐ ভিক্ষুকের কথাই সত্যি- ‘‘হাছা কথার ভাত নাই’’।