যেখানে হাসি নাই, সেখানে কোন সৌন্দর্যই নাই

ব্যক্তিত্ব চেনার ও প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম হাসি। জগতে যতজন মানুষ ততো প্রকারের হাসি। হাসি মূলত তিন প্রকার। মুচকি, দাঁত দেখানো হাসি ও অট্টহাসি। মৌলিকভাবে হাসি যদিও তিন প্রকার, কিন্তু হাসির ধরন ও সৌন্দর্য নিয়ে প্রকার আছে অনেক৷ যারা হাসি বিষয়টাকে হাস্যকর ভাবেন তারা কিছুটা নির্বোধ৷ কখনো কখনো পুরোটাই নির্বোধ। কারণ, হাসির বিষয়ে জ্ঞানীরাও সচেতন। হাসি বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ৷ হাসির সৌন্দর্য তার চেয়ে বড় অনুগ্রহ। হাসি আর কান্নাঁ দু’টিরই মধ্যে সৌন্দর্য আছে। হাসি জন্মগতভাবে পেলে ভালো, না হয় অনুশীলন করা বাঞ্ছনীয়। তিন হাসির মধ্যে মুচকি হাসিই সেরা। তবে তার আছে সীমাহীন অর্থবোধক৷ এ ছাড়াও অারও কিছু হাসি আমাদের চারপাশের মানুষ গুলোর মধ্যে দেখা যায়।
ব্যক্তিত্ব চেনার ও প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম হাসি | আমির হোসেন
১. রহস্যপূর্ণ হাসি- পত্রিকায় পড়েছিলাম ভ্লাদিমির পুতিনকে সাংবাদিকরা শুধু একবারই হাসতে দেখেছিল। তাও খুব ক্ষীণ। রহস্যপূর্ণ হাসি বুঝতে অনেক সময় লাগে৷
২. দুঃখের হাসি- কখনো কখনো চক্ষু সজল, ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি হঠাৎ ফোটে উঠে নিমেষেই মিলিয়ে যায়। অনুধাবন করতে সক্ষম না হলে ব্যথীর সমব্যথী হতে আপনি পারবেন না৷
৩. সুখের হাসি- কখনো মনের আনন্দে অাবার কখনো প্রাপ্তির আনন্দে। কখনো মিলনের সুখে, কখনো আপনজনের সাক্ষাতে। এটা কখনো কখনো মুচকি থেকে অট্টহাসিতে রূপ নেয়।
৪. অট্টহাসি- অট্টহাসির একটা অংশ অধিকাংশ অত্যাচারী, সন্ত্রাসী, দুর্বলের উপর বল প্রয়োগ করার সময় প্রভুত্বের আনন্দে হাসে৷
৫. কুটিল হাসি- ঠগবাজ, প্রতারক ও মুনাফিকরা দেয়৷ মনের গোপন পরিকল্পনার ফাঁদে কাউকে ফাঁসাতে পারলে বা ভবিষ্যতে ফাঁসানোর অসদিচ্ছা থাকলে।
৬. রসিকতার হাসি- কোনো অর্থ নেই, কেবলই রসিকতা। হিহিহি হাহাহা হুহুহু!
৭. গম্ভীর হাসি- গম্ভীর মানুষের গম্ভীর চেহারায় ভারি হাসি। তাহারা আনন্দে বিষাদে একইরকম হাসি দেয়, বোঝা কষ্টকর৷
৮. সরল হাসি- সরল লোকের সাদাসিধে হাসি। এরা হাসিতে মনের কথাটা পরিষ্কার করে বলে দেয়৷ এ কারণে এরা কষ্টও বেশি পায়।
৯. বিষণ্ণ হাসি- বিষাদে যখন কান্নার জন্যে চোখে আর জল থাকে না। কাউকে বুঝানোর মতো পরিবেশ আর থাকে না তখন বিষণ্ণতার হাসিই বিষণ্ণ লোকের সঙ্গী।
১০. আবেদনের হাসি- প্রেম ও আকর্ষণের পূর্ণরূপ হাসি। ভালো আর মন্দ উভয়টি প্রকাশ পায়। যে ভুল বুঝে সে ঘৃণা করে, যে ঠিক বুঝে সে সম্মতির হাসি দেয়।
১১. সন্তুষ্টির হাসি- সবাই বুঝে৷
১২. অসন্তুষ্টির হাসি- রাগে হাসে ঠোঁটের কোণে৷
১৩. আনন্দ দানের আদরের হাসি- বাচ্চাদের প্রতি বড়দের হাসি।
১৪. দুষ্টু হাসি- পতি ও পত্নীর পারষ্পরিক ভালবাসা বাড়লে যে হাসি দেয়।
১৫. তাজ্জবের হাসি- বিস্মিত হয়ে যে হাসি দেয়৷
১৬. অপারগতা ও অক্ষমতার হাসি- এতোটা কাছে যে, ছোঁয়া যায় কিন্তু ছুঁতে পারে না৷ মর্মে জমা থাকে না বলা অনেক কথা। কিন্তু সেসব কথার ভাষা নেই৷ ব্যক্ত করার সাধ্য থাকে না, তখন উদ্দিষ্ট কেউ পাশে দাঁড়ালে প্রকাশের অক্ষমতার যে হাসি দেয়, এ হাসিটা বড় করুণ। চোখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট৷ ঠোঁট কামড়ে তবু হাসে৷
১৭. সুক্ষ্ম হাসি- বিদ্যুৎ বেগে আসে আবার হারিয়ে যায়। এমন হাসির মর্ম কিন্তু বোঝা বড় দায়৷

যেখানে হাসি নাই, সেখানে কোন সৌন্দর্যই নাই। প্রতিটি মানুষের আছে, সুন্দর ভাবে হাসিঁ-খুশি আনন্দময় ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। হাসি বিধাতার এক বিশেষ দান। হাসি আর বিবেকবোধ মানুষকে অন্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। মানুষ যখন কষ্টে মানুষ কাঁদে, তখন ইতর প্রাণীর চোখেও পানি আসে। মানুষের মতো ইতর প্রাণী হাসতে পারে না। মানুষই একমাত্র বিবেকবোধসম্পন্ন প্রাণী যারা আনন্দে হেসে মনের উচ্ছ্বাস আবেগ প্রকাশ করতে পারে। গোমরা মুখ কারও পছন্দ নয়। হাসি মানুষের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়। হৃদয় হরণ করে, তেমনি হাসি অন্যের মুখের হাসি ফোটাতেও পারে। এমনকি প্রাণখোলা হাসিতে নিজের ভেতরটাও হালকা হয়। হাসিতে মুক্তা ঝরে, হাসিতে অভিমান ভাঙে। ভুবন ভোলানো হাসি সত্যিকার অর্থেই মোহনীয়, আদরণীয়। মুখের সৌন্দর্যের বড় একটি দিক সুন্দর হাসি। প্রাণখোলা হাসি অনেকের সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। মানুষ বাস্তবতার কাঠিন্য থেকে মুক্তি খোঁজে। প্রাণখোলা নির্ভেজাল হাসি দিয়েই এ মুক্তি অর্জন সম্ভব।

বিখ্যাত এক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন- ‘হাসি মানুষের উত্কৃষ্ট এনার্জি বা শক্তির বহিঃপ্রকাশ।’ গোমড়ামুখো কোরিয়ানদের হাসাতে তৈরি হয়েছে স্কুল, লাফিং সেন্টার। এই লাফিং সেন্টারের প্রশিক্ষক জোসেফ লি বলেছেন, ‘হাসতে শেখার পর সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে গেছে।’ এমন ঘটনা অবশ্য আমাদের হাস্যরসপ্রিয় জাতির কাছে অবাস্তব মনে হবে। পয়সা খরচ করে হাসি, তাও আবার স্কুলে গিয়ে, ভাবাই যায় না। কষ্টে আমরা যেমন কাঁদতে জানি, দুঃখ-ক্লেশ, কষ্টকে উপেক্ষা করে প্রাণ খুলে আমরা হাসতে জানি, হাসির ভেলায় ভাসতে। হাসির জন্য এমন কায়দা অন্তত আমাদের করতে হয় না। আমরা দুঃখে যেমন কাঁদতে জানি, আনন্দে প্রাণখোলে হাসতেও জানি।
আমাদের দেশে আড্ডায় হাসির বর্ষণ নতুন কিছু নয়। আড্ডায় হাসতে হাসতে মেয়েরা একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য নতুন নয়। এই ঐতিহ্যবাহী হাসি বহু পুরনো। মেয়েদের তুচ্ছ কথায় হাসির কারণ শুনে কোনো পুরুষের মনে হতেই পারে, এর জন্য এত হাসির কি হলো? আর তাই তো নারীর হাস্যরস আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়ে পুরুষ কবিরা রহস্যময় বলেছেন। এমনকি বিশ্ব বিখ্যাত মোনালিসার ঠোঁটের কোণে ধরে রাখা এক্টুখানি হাসির রহস্য আজও বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, আবিষ্কার করতে পারেননি। ছেলেদের হাসির রহস্য উদ্ঘাটনের এত সময় মেয়েদের না থাকলেও ছেলেদের কিন্তু মেয়েদের হাস্যরহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় কোনো কমতি নেই, শেষ নেই। স্বভাবগত কারণে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি হাসে এবং এ হাসি দেখে প্রতিদিন গোপনে-প্রকাশ্যে কত পুরুষের হৃদয় খুন হয়, হৃদয়ক্ষরণ হয় সে হিসাব কারও জানা নেই। নির্লিপ্ত হাসিতে প্রতিদিন কত হৃদয় হরণ হয় তারও ইয়ত্তা নেই। তারপরও সুন্দর, স্বতঃস্ফূর্ত হাসিই সবার কাম্য। সব সময় হাসিমাখা সুন্দর মুখেরই জয়। মানুষের চেহারার সম্পূর্ণ সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় যদি তার মুখে হাসির ঝলক না থাকে। অনেক সুখে, স্বপ্ন পূর্ণতা বা পাওয়ার আনন্দেও মানুষ কেঁদে ফেলে। কিন্তু সে সুখের কান্নার পরিসমাপ্তি ঘটে হাসি দিয়ে। কয়েক মাসের শিশু যখন ঘুমের ঘোরে ঠোঁট বাঁকা করে হাসে, তখন সেই শিশুর নির্ভেজাল নিষ্পাপ হাসি দেখে খুশিতে মায়ের দুচোখ সিক্ত হয়। আনন্দ অশ্রুতে চোখ ভিজে যায়, সে হাসি দেখার জন্য বিছানার চারপাশে জড়ো হয়ে বসে থাকে পরিবারের সবাই। শিশুর নিষ্পাপ হাসি সংক্রমিত হয় সবার মুখে। আবার শত দুঃখেও মানুষ হাসতে পারে। যন্ত্রণাকে অবজ্ঞা করে, কষ্টকে তাচ্ছিল্য করে সবাই না পারলেও কেউ কেউ হাসতে পারেন। হাসির আড়ালে লুকায়িত অব্যক্ত যন্ত্রণা সেই হাসিকে দেয় ভিন্ন ব্যঞ্জনা। অনেকে হাসি পেলেও চেপে রাখেন, পাছে মন খুলে হাসলে ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়। কিন্তু হাসির কথায় প্রাণ খুলে হাসা উচিত। অনাবিল আনন্দের সুযোগ হাতছাড়া না করে বরং উপভোগ করা উচিত। মনে কষ্ট জমলে কাঁদুন মন ভরে। আবার হাসির কারণ খুঁজে পেলে হাসুন প্রাণ খুলে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো।

হাসির উপকারিতাঃ-
হাসি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। হাসলে শরীরের ইমিউন কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। রক্তে এড্রেনালিনের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে সর্দি, কাশি, জ্বর বা ছোটখাটো রোগ আক্রান্ত করার সুযোগ পায় না। অনেক রোগ নিজে নিজেই সেড়ে যায়। হাসি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকাতে আমাদের ৪৩টি পেশীকে পরিশ্রম করতে হয় আর মুচকি হাসতে লাগে মাত্র ১ টি। তাই সুস্থ থাকার মহৌষধ হাসি। হাসি শরীরকে চিন্তামুক্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে কার্যকর করে তোলে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ কিংবা উদ্বেগ কমিয়ে, হাস্যরস শরীরে রোগ প্রতিরোধের জন্য দরকারি কোষ এবং অ্যান্টিবডির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর হাসি-তামাশার প্রভাব নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর ফলাফলও বেশ মজার। বলা হচ্ছে হাসি-তামাশা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর জন্য সহায়ক। হাসি এক অমূল্য ওষুধ। অনেক গবেষণায় প্রমাণ করা হয়েছে, হাসলে আঘাতজনিত ব্যথার অনুভূতি অনেক কমে যায়।

মুলকথাঃ
হাসি সামাজিকায়নের চাবিকাঠি। হাস্যরসিক ব্যক্তি বন্ধু, পরিবার-পরিজনের মাঝে সুখী মানুষ। এটা হাসির কারণে নাকি সুখী পরিবারের ফসল হাসি, তা নিয়ে অযথা বিতর্ক না করে, আমরা সবার মুখে হাসি চাই। নিঃসঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে বন্ধু-বান্ধব পরিবেষ্টিত ব্যক্তি ৩০ গুণ বেশি হাসেন। যারা হাসেন তাদের সঙ্গে আশপাশের মানুষের সংযোগ অধিকতর ঘনিষ্ঠ। স্বাস্থ্যের ওপর তাহার ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। হাসি স্বাস্থ্য সুরক্ষার মহৌষধ। কিন্তু আমরা শুধু বাঁচার জন্য হাসি না। পরিবার প্রিয়জনের সঙ্গে হাস্যময় আন্তরিকতা আমাদের আত্মিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। মানুষের আসল হাসি মনে, আপনার মনকে প্রফুল্ল করার প্রধান হাতিয়ার হাসি। তাই, মন খুলে হাসুন। তবে অভিনয় করে নয়, জোর করে নয়। তাহলে বিপরীত হবে। আপনি হাসির আনন্দ থেকে দূরে সরে যাবেন। ৩ মে পৃথিবীর নানা দেশে ‘বিশ্ব হাসি দিবস’ পালিত হয়। ১৯৮৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ের ডক্টর মদন কাটারিয়া এই হাসির দিনটি সূচনা করেন। হাসি হলো ইতিবাচক এবং আবেগ প্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। মানুষ তার চারপাশ এবং পুরো পৃথিবীকে বদলে দিতে যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন তার সবটুকুই আছে হাসিতে। বিচিত্র এ হাসি নিয়ে গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। অভিন্ন মতবাদ খুঁজে না পেলেও যায়-আসে না। হাসি চিরঞ্জীব হোক, সবার মাঝে সংক্রমিত হোক। এটাই প্রত্যাশা।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form