এই জীবনের গ্লানি অবসান হবে কবে?

সংসারের লাগামহীন নানা বোঝা টানতে টানতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন, সময়ের পরিক্রমায় হয়ে পড়েন অক্ষম, শক্তিহীন এক বৃদ্ধা। শুধু অগাধ স্নেহ ছাড়া সন্তানদের আর কিছুই দেয়ার থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ সন্তানেরাই ভুলে যায়, কিভাবে তারা এত বড় হয়েছে?
নিজ সংসারের লাগামহীন নানা বোঝা টানতে টানতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন | আমির হোসেন
এর পেছনে কত নির্ঘুম রাত কেটেছে মায়ের, ছেলে-মেয়েদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে বাবাকে। একদিন তারাও সংসারি হয়, সন্তানের মা-বাবা হয়। কিন্তু মা-বাবার গভীর আত্মত্যাগ, তার কোন আচড় কাটে না তাদের কঠোর মনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, জীবনসঙ্গিনীকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেই ব্যস্ত তারা। অক্ষম প্রবীণ মা-বাবার সেবা-যত্ন করা তো দূরের কথা, উল্টো তাদের বোঝা মনে করে। তারা ভুলে যায়, কি গভীর স্নেহে, অমানুষিক পরিশ্রম করে, নিজেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে তাদের মানুষ করেছে। আজ যে তারা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, এর পেছনে কত রক্ত পানি করা পরিশ্রম তাদের মা-বাবা দিয়েছেন, এমনকি তা মনে রাখতেও চেষ্টা করে না তারা। বরং বৃদ্ধ অক্ষম বাবা-মাকে অপাৎতেয় মনে হয় তাদের। তাদের সোসাইটিতে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে তারা। যদি বাসায় থাকতেও দেয়, ছোট অপরিসর নোংরা ঘরে ফেলে রাখে পুরানো আসবাবপত্রের মত। আবার এও দেখেছি ২/৩ জন সন্তান থাকলে মা-বাবাকে ভাগাভাগি করে খাবার দেয়। কোন কোন নির্লজ্জ সন্তান গর্ভধারিণী মা-বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেয়। এমন মর্মান্তিক অবস্থায় মা-বাবা শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে যান, অক্ষম অসহায় সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কোনদিন তাদেরই গর্ভজাত সন্তানেরা তাদের এতটা দুঃখ দিতে পারে। এ রকম যন্ত্রণাকাতর পরিস্থিতিতে কারও কারও জীবনের প্রদীপ নিভে যায়। কেউ বা রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এবং মানবেতর জীবনযাপন করেন, আর মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে, কেউ বা আশ্রয় পান বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রম-বয়স্কদের আশ্রয় কেন্দ্র। প্রাণপ্রিয় সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে থেকে চরম অবহেলা আর অবজ্ঞা পেয়ে আশ্রয় পায় এই শেষ ঠিকানায়। আর ভাবতে থাকেন, এই জীবনের গ্লানি অবসান হবে কবে?

বৃদ্ধ বয়সে প্রত্যেকেই চায় নাতি-নাতনি নিয়ে আদর-সোহাগে মেতে থাকতে, তাদের কাছে পুরানো দিনের গল্পে শুনতে। কিন্তু সন্তানদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে তারা দুঃসহ নিঃঙ্গতায় দিন বৃদ্ধাশ্রমে করছে। এমনও দেখা গেছে, বৃদ্ধাশ্রমে কেউ ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে দেখতে গেলে, ঐ হতভাগ্যরা ক্ষণিকের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। তাদের কাছে টানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, পরক্ষণেই দু'চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়তে থাকে। হয়ত বা প্রাণপ্রিয় নাতি-নাতনির কথা মনে পড়ে যায়। ধিক্ ঐ কুলাঙ্গার সন্তানদের আর তাদের আত্মীয়-স্বজনদের, যারা আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। হয়ত কেউ কেউ সভা-সমাবেশে মানবাধিকার নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেন। মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় হয়ত বড় অংকের চাঁদা দেয়। বড় বড় আদর্শের বুলি দিয়ে থাকেন। কিন্তু মা-বাবার মনে আঘাত দিয়ে অন্য যত বড় কাজই করুক না কেন, এমনকি ধর্মস্থানে গিয়ে মাথা ঠুকলেও সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। প্রতিটি ধর্মেই বলা হয়েছে, মা-বাবা পায়ের নিচে স্বর্গ বা বেহেস্ত। মাকে বলা হয়েছে, মা-স্বর্গাদপী গরীয়সী। এর মর্মার্থ ঐ কুলাঙ্গাররা উপলব্ধি করতে পারেনি। যদি পারত, তবে মা-বাবার অন্তরে এরকম অমানুষিক যন্ত্রণা দিতে পারত না, বরং তাদের সযত্নে, শ্রদ্ধাভরে উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখত।

ক্ষুদ্রস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বার্থে আজ সমগ্র বাংলাদেশ জর্জরিত। তাই স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও দেশে অন্যান্য ক্ষেত্ররমত ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধেরও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। এই ব্যক্তিস্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে একান্নবর্তী পরিবার ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। কোন ছেলের বৌ শ্বশুর-শাশুড়ি, চাচা-চাচী, ভাই-ভাবী, দেবর-ননদ নিয়ে আজ আর সংসার করতে চায় না, অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রায়ই দেখা যায় বিয়ে করার পর প্রাণপ্রিয় সন্তান ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। তারাও যে একদিন মা-বাবা হবে, এ কথাটি পর্যন্ত ভুলে যায়। তাদের সন্তানেরাও এ ধরনের ন্যক্কারজনক ব্যবহার একদিন ভবিষ্যতে করতে পারে, এ কথা একবারও মনে জাগে না তাদের। একটুও বিবেকে তাড়িত না হয়ে অমানুষের পর্যায়ে নেমে আসে তারা। আর ভাবে তারা যা করছে ঠিকই করছে।

2 Comments for "এই জীবনের গ্লানি অবসান হবে কবে?"

  1. জীবন মানেই সংগ্রাম

    ReplyDelete

  2. সহমত প্রকাশ করলাম

    ReplyDelete
Previous Post Next Post

Contact Form