বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, কৃষি নির্ভর সমাজ আর কৃষক দেশের সূর্য সন্তান। কৃষক হচ্ছে এমন এক কারিগর যা প্রতিনিয়ত সাধনার মাধ্যমে বীজ থেকে ফসল ফলায়। যোগান দেয় আমাদের মুখের খাবার। চাষি, তাঁতি, জেলে এরা সবাই সেদিন ছিল বাংলার কৃষক সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত। এই কৃষক সমাজের মানুষদের শ্রমজাত সম্পদই ছিল এ ভূখন্ডে সবার বাঁচার উপকরণ। বিশেষ করে এক সময়কার অবিভক্ত বঙ্গের যে অংশটুকু নিয়ে আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠিত, সে ভূখন্ডটি মূলত কৃষক সমাজের ওপরই নির্ভরশীল। এখন যদিও শিল্প-কারখানার কিছুটা বিস্তার ও প্রসার এখানে ঘটেছে, তবু এখনো কৃষিই এ দেশের অর্থনীতির চাকাটা সচল রেখেছে।
মাটিতে শস্য ও জলে মৎস্য চাষ করে যারা, সেই জেলে, চাষি ও জেলে-চাষিদের ওপর ভর দিয়েই আজও বাংলাদেশে চলিতেছে সমস্ত সংসার। আগেও যেমন এখনো তেমনই, চাষিদের শ্রমফল অপহরণকারী তথাকথিত ভদ্রলোকরা চাষিদের সম্পর্কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই কথা বলে। চাষিকে ‘‘চাষা’’ কিংবা ‘‘চাষাভুষা ছোটলোক’’ আখ্যা দেওয়াটাও এ রকমই তুচ্ছতাবোধক। ‘‘চড়া কথা ফাটা পায়, ছোটলোক চেনা যায়’’- এ রকম একটি প্রবচনও বানিয়েছে একান্ত অভদ্র এই ভদ্রলোকরাই। ভদ্রলোকরা যেমন মনে এক রকম ভাবনা চেপে রেখে মুখে, আরেক রকমের কথা একান্ত অবলীলায় মিহি সুরে বলে যেতে পারে, চাষাভুষা ছোটলোকরা তেমনটি পারে না। তাদের মনোগত ভাবনা আর মুখনিঃসৃত কথায় কোনো ফারাক থাকে না। ভদ্রলোকদের মতো মিহি সুরের কপটতার আশ্রয় নিতে তারা জানে না, তাই স্বভাবতই তাদের গলার স্বর সর্বদা ‘‘চড়া’’ থাকে। আর পা তো তাদের ‘‘ফাটা’ই থাকবে’’। কারণ
‘‘মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ’’ তেমন ‘‘মাটির মালিক’’ ভদ্রলোকদের মতো চরণ পাদুকাবৃত করে শ্রমনিরত ছোটলোকরা শস্য ও মৎস্য উৎপাদন বা আহরণ করতে পারে না। তাই শোষিত ছোটলোকদের ‘চড়া কথা’ ও ‘ফাটা পা’ নিয়ে প্রবচনটি রচনা করেছে যারা, সেটি সেই ভদ্রলোকদেরই শোষকচরিত্রের আবরণ খুলে দিয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, বাংলার সমাজনাট্যে সরলপ্রাণ চাষাভুষা ছোটলোকরাই মূল নায়ক, আর কপটচিত্ত ও ধড়িবাজ ভদ্রলোকরাই প্রতিনায়ক বা খলনায়ক। অথচ এই খলনায়করাই মূল নায়কদের আসনটি দখল করে নিয়ে নিজেরাই নায়ক হয়ে বসেছে শুধু বাংলায় নয়, পাশ্চাত্য দেশেও। কৃষক যেহেতু একাল অবধি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিরূপে বিদ্যমান, তাই এখানকার রাজনীতির উত্থান-পতনের চাবিকাঠিটিও থাকে কৃষকের হাতেই। সমকালের বাস্তবতায়ও এ রকম দেখি, দূর বা নিকট অতীত কালের ইতিহাসেও এ রকমই ছিল প্রাক-আধুনিককালে বাংলা তথা ভারতবর্ষে সমাজরথের চালকের আসনটি ছিল কৃষকেরই দখলে। সেকালে এখানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা সর্বশক্তিমান হয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কৃষক ও কৃষকসমাজ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন পেশার মানুষ ও ছাত্র-যুবকরাই ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আলবদর, আলশামস, রাজাকার বা শান্তি কমিটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দেশদ্রোহীদের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অধ্যুষিত শহর-বন্দরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের কৃষকসমাজে এ রকম কুলাঙ্গারদের অবস্থান প্রায় ছিল না বললেই চলে। সে সময় দেশের গ্রামে গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কৃষকরাই শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে দিয়েছে, শত্রুদের গতিবিধির সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। গ্রামীণ কৃষকসমাজের মাতা, বধূ-কন্যারাও এই মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন অসাধারণ অবদান। তাঁদের অবদান শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য-পানীয় জোগানোর মধ্যেই সীমিত থাকেনি, হাতা-খুন্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত অনেক নারীই বোমা, বন্দুক, গ্রেনেড হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও করেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার কাজেও প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে মেহনতি কৃষকসমাজের নর-নারীরই। ঝড়, বৃষ্টিবাদল, সিডর, খরা, বন্যার মতো প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবিলা করে উৎপাদনের প্রক্রিয়াটিকে সচল রাখতে গিয়ে সমাজসৃষ্ট সংকটের মুখে পড়েও প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে তারা। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে সেই গুটিকয়েক মানুষই, যারা প্রতিনিয়ত কৃষকের শ্রমফল অপহরণ করে নিচ্ছে, যারা নিজেরা খলনায়ক হয়েও মূল নায়কদের আসনটি অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছে। যারা সন্তানসম জমির লালন-পালনকারীদের বঞ্চিত করে নিজেরাই ‘জমিদার’ হয়ে বসেছে। যারা জোঁকের মতো জনগণকে শোষণ করেই হয়েছে ‘মহাজন’। আশা করা হয়েছিল যে দেশ স্বাধীন হলে এই জমিদার ও মহাজনদের উৎপাত ও দৌরাত্মের অবসান ঘটবে। কিন্তু ঘটল তার বিপরীত। গ্রামগঞ্জে আগের চেয়েও প্রচন্ড শক্তিধর জমিদার মহাজনদের উদ্ভব ঘটে গেল। তাদের প্রবল প্রতাপে বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র কৃষক আজ জমির ওপর অধিকার হারাতে হারাতে ভূমিহীন ও গৃহহীন হয়ে পড়ছে। এই তথ্য পত্রপত্রিকায় অনেক প্রকাশিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় মদদপুষ্ট এই লুটপাটতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামই বাংলাদেশের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর তথা স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করার সংগ্রাম। সে সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলেই ‘মাটিতে যাতে ঠেকে না চরণ’ তেমন অসংগত মাটির মালিকদের হাত থেকে কৃষি ও কৃষকের মুক্তি ঘটবে, ‘সন্তানসম পালে যারা জমি’ তারাই হবে জমিদার। কৃষিই আসলে যে দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড, মূলত কৃষকের আত্মত্যাগই যে দেশকে মুক্ত করেছে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। কৃষকই যে দেশের রাজনীতির প্রকৃত নিয়ন্তা, কৃষকের সংস্কৃতিই যে দেশের সংস্কৃতির ভিত্তি, কৃষক বাঁচলেই বাঁচবে সে দেশ। কৃষিকার্য পেশায় নিয়োজিত থেকে ফসল উৎপাদন করেন। পাশাপাশি তিনি খাবারের উপযোগী করে গৃহপালিত প্রাণী লালন-পালন করেন। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে এ পেশার মাধ্যমে কৃষক মানুষের জন্যে খাদ্য সরবরাহ করে জীবনকে চলমান রেখেছেন।